
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর গ্রামের জন্মান্ধ হেলাল মিয়া (৬৫) এবং তার পরিবার প্রায় পাঁচ দশক ধরে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১৩ সদস্যের এই পরিবারের ৯ জনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জেলা শহরের পৌর মুক্তমঞ্চ ছিল তাদের জীবনের একমাত্র ভরসা-প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত গান শুনিয়েই চলত সংসার।
কিন্তু গত বুধবার দুপুরে কয়েকজন মাদরাসাছাত্র গান করতে বাধা দিলে এবং বাদ্যযন্ত্র ভাংচুরের হুমকি দিলে থমকে যায় তাদের জীবন। ভয়ে বন্ধ হয়ে যায় গান, বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগারও। জন্মান্ধ এই পরিবারটি ছয় দিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করেন।
মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সকালে আবারও গানের আসর শুরু করেন হেলাল মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা। তবে এখনও তাদের মনে ভয় কাটেনি। আগের জায়গাটি হকাররা দখল করে নেওয়ায় পাশের একটি স্থানে বসে গান করেন তারা।
হেলাল মিয়া জানান, ইসলাম ধর্ম মানলেও তারা কখনো ধর্মবিরোধী গান করেন না। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তিনি পুরাতন কাচারি এলাকা ও মুক্তমঞ্চে আধ্যাত্মিক গান-মারফতি, মুর্শিদী, কাওয়ালী-শুনিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তিনি বলেন, আমরা জন্মান্ধ মানুষ। ভিক্ষা করি না। গান শুনে মানুষ যা দেয়, তা দিয়েই চলে সংসার। ছয় দিন রোজগার বন্ধ থাকায় মনে হয়েছিল না খেয়েই মরতে হবে।
পরিবারের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সদস্যরা হলেন-ছেলে সাদেক (৪৫), ফারুক (৩০), তারেক (২৫), বারেক (২০), মেয়ে খায়রুন্নেছা (৪০) এবং নাতনি রোকসানা (১৬), নাতি মোস্তাকিম (১১) ও মুজাহিদ (১০)।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন- আমরা কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার প্রিন্সিপাল মুফতি মুবারক উল্লাহ বলেন,আমাদের কোনো ছাত্র বাধা দিয়েছে-এ তথ্য জানা নেই। গান আমরা সমর্থন করি না, তবে কাউকে বাধা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়নি।
হেলাল মিয়া জানান, বিষয়টি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লাকে জানালে তিনি গানের আসরে ফিরে যেতে সাহস দেন। তার আশ্বাসে মঙ্গলবার সকাল থেকে আবার গান শুরু করেছে পরিবারটি।তিনি বলেন,আজ কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ভয় এখনও কাটেনি। আগেও দুই দফায় বাধা দেওয়া হয়েছিল। আবার কিছু হলে কী করব এই দুশ্চিন্তা আছে।দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ৯ সদস্যের এই পরিবারটি এখনও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। গানই তাদের জীবিকা। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা ও হুমকিতে ভয় পাচ্ছেন তারা।
হেলাল মিয়ার আক্ষেপ, আমরা কারো ক্ষতি করি না। শুধু বাঁচার জন্য গান গাই। যদি এটাও করতে না পারি, তাহলে আমাদের বাঁচার পথটাই বন্ধ হয়ে যাবে।দীর্ঘদিন ধরে গান শুনিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে বেঁচে থাকা এই জন্মান্ধ পরিবারের জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা, স্থায়ী সমাধান এবং মানবিক সহায়তা-এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা।
মন্তব্য করুন