রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

চোখে দেখেন না, তবু ফেরি করে সংসার চালান মাবুদ

বৈশাখী প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:০৫ পিএম
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:১৭ পিএম

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শক্তি মনোবল, যা হার মানায় শারীরিক অক্ষমতাকেও। সেই সত্যের জীবন্ত উদাহরণ দিনাজপুরের অন্ধ আব্দুল মাবুদ, যে দুই চোখের দৃষ্টি হারালেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর আত্মসম্মান আজও ধরে রেখেছে নিজের কাজে, নিজের উপার্জনে।

হিলি পৌরসভার ছোট ডাঙ্গাপাড়ার আব্দুল মাবুদ জন্ম থেকেই কম দেখতেন, এখন ৬৫ বছর বয়সে এসে পুরোপুরি অন্ধ। স্ত্রীকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে নিজেরা না খেয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা করিয়েছেন। বিয়ে-শাদির সব দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ আজ সেই সন্তানই তাদের খোঁজ রাখে না। সন্তান থাকা সত্ত্বেও বাবা, মাকে অসহায়ভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়। এ যেন শুধু এক পরিবারের নয়, সমাজেরও গভীর ব্যর্থতা।

প্রতিদিন সকাল হলেই কাঁধে বাহক ঝুলিয়ে ৩০০-৪০০ টাকার বাদাম, বুট, কটকটি আর মিঠাই নিয়ে রাস্তায় বের হন তিনি। হিলি পৌর শহরের মাঠপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, চারমাথা, মহিলা কলেজ, চুড়িপট্টি—এসব এলাকায় ভাঙ্গারির বিনিময়ে বিক্রি করেন খাবার। মানুষের দয়া নয়, নিজের পরিশ্রমেই সংসার চালান তিনি।

বলা হয়, অন্ধ মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। মাবুদের ক্ষেত্রেও তাই। চোখে দেখতে না পেলেও মনের চোখ দিয়ে পথ চিনে নেন। কোথাও ভুল হলে আশপাশের মানুষকে অনুরোধ করে পথ জেনে নেন। মানুষও তাকে সাহায্য করে।

প্রায় প্রতিদিন দুপুরে হাকিমপুর থানার মসজিদে নামাজ আদায় করতে দেখা যায় তাকে। নামাজের পর মসজিদের বারান্দায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এখানেই তাকে চিনেছেন অনেক মানবিক পুলিশ সদস্য, যারা প্রয়োজন হলে পাশে দাঁড়ান।

সাউফুল ইসলাম, রাসেদুল ইসলাম, এনামুলসহ এলাকার কয়েকজন বলেন, প্রায়ই দেখি দু’জনকে বস্তা নিয়ে হাঁটতে। খুব কষ্ট লাগে। ছেলেমেয়ে থাকলে বাবা, মাকে এই বয়সে এভাবে ঘুরতে হয় কেন? তবু তারা কারও কাছে হাত পাতেন না। নিজেরা কষ্ট করে রোজগার করেন। মাবুদ চোখে দেখতে পান না, কিন্তু মনের চোখে পথ চলেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অন্ধ মাবুদের স্ত্রী বলেন, “মানুষ ছেলেমেয়েদের কতো আশা নিয়ে মানুষ করে। আমরা অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু আমাদের কপালে কষ্টই লেখা। তাই এই বয়সেও স্বামীর সঙ্গে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।”

অন্ধ আব্দুল মাবুদ বলেন, “নিজেরা না খাইয়া ছেলেটারে খাওয়াইছি। লেখাপড়া, বিয়া সব দিছি। এখন সে আমাদের চেনে না। কিন্তু বাঁচতে তো হইবো। তাই চোখে দেখি না তবু ফেরি করি, গ্রামে গ্রামে ঘুরি। যেটুকু কামাই হয় তাই দিয়া কোনো রকম চলে। কষ্ট আছে, কিন্তু শান্তি আছে, কারো কাছে হাত পাতি না।”

হাকিমপুর (হিলি) থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল হক বলেন, “প্রায়ই দেখি তিনি থানা মসজিদে নামাজ আদায় করেন, পরে বারান্দায় বিশ্রাম নেন। একদিন তার জীবনের গল্প শুনে সত্যিই স্তব্ধ হয়ে যাই। অর্থের অভাবের চেয়েও বড় অভাব হচ্ছে সম্মান, ভালোবাসা ও যত্নের অভাব; যা এই মানুষটির জীবনে নেই। আমরা তাকে সাহায্য করেছি এবং যতটা পারি পাশে থাকবো। সমাজের সবাইকেই এমন মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।”

আজ অন্ধ মাবুদের মতো মানুষেরা অন্ধকারেই পথ খুঁজে নিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
অর্থ পরিশোধ না করেই মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ
অর্থ পরিশোধ না করেই মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ
ঘোড়াঘাটে অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনী সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন
সেনাবাহিনীর উপর হামলার প্রতিবাদ / ঘোড়াঘাটে অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্রবাহিনী সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন
কুকুরছানা হত্যা মামলায় জামিন পেলেন সেই গৃহবধূ
কুকুরছানা হত্যা মামলায় জামিন পেলেন সেই গৃহবধূ
ঠাকুরগাঁওয়ে পুলিশ সুপারের সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময়
ঠাকুরগাঁওয়ে পুলিশ সুপারের সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময়