
বিশ্বের শক্তিশালী দেশ আমেরিকার পর যে দেশটির নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত, তা হলো চীন। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যাকে বলা হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। অথচ আশির দশকের আগে দেশটি ছিল দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি।
বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮১ থেকে ২০১২—এই সময়ের মধ্যে চীন ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে এনেছে। ২০১২ থেকে ২০১৮—এই ছয় বছরে দেশটির দারিদ্র্যের হার আরও ছয় শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে দেশটির দারিদ্র্যের হার ২ শতাংশে পৌঁছায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—গত তিন যুগে চীন এমন কী করেছিল, যাতে তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক রাষ্ট্রে পরিণত হলো? এক সময়ের দরিদ্র দেশটি তাদের কঠোর পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে প্রযুক্তির দৌড়ে এখন অনেক এগিয়ে। ইলেকট্রনিক সামগ্রী, মোবাইল ফোন ও এর অন্যান্য যন্ত্রাংশ আবিষ্কার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে আধুনিক চীন।
বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের বসবাস, এবং যাদের অধিকাংশের পোশাক সরবরাহ করে চীন। বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে চীন প্রথম অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের মোট জাহাজের প্রায় ৫০ শতাংশই প্রস্তুত করছে তারা। এছাড়াও সিমেন্ট শিল্প থেকে শুরু করে নানা প্রকার নির্মাণশিল্পে সারাবিশ্বে রাজত্ব করছে আধুনিক চীন।
যেভাবে স্বনির্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো চীন
অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী করতে চীন নিয়েছিল ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এ জন্য ১২ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল দেশটি। সরকারের বক্তব্য ছিল—এত ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী করবে? কারণ, চাকরি দেওয়ার মতো ব্যবস্থা তখন তাদের ছিল না।
তাই প্রথমে ছেলে-মেয়েদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। এরপর তারা সবাই নিজ নিজ বাড়িকে কারখানা হিসেবে গড়ে তোলে। পরিবারের সবাই কাজে লেগে পড়ে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচও কমে যায়। ফলে সস্তায় পণ্য উৎপাদন করেও এগিয়ে যায় চীন।
পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো চীনে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। আইফোন থেকে শুরু করে আপনার হাতের দামী স্মার্টফোন কিংবা ফোনের কোনো না কোনো যন্ত্রাংশ চীনের তৈরি। স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রির ৪৮ শতাংশই চীনের দখলে। পৃথিবীতে যে পরিমাণ স্মার্টফোন উৎপাদন হয়, তার ৭০ ভাগই চীন উৎপাদন করে।
এছাড়া বিশ্বের অনেক নামী-দামী গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও চীনে গাড়ি তৈরি করছে। যেকোনো পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদনে চীন সবার থেকে এগিয়ে। সৌর বিদ্যুতের জন্য বিশ্বের যত সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশ চীনে উৎপাদন হয়। এছাড়া সিমেন্ট এবং সিরামিক শিল্পেও পুরো বিশ্বে রাজত্ব করছে চীন।
দেশটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারত কিংবা বাংলাদেশের তুলনায় প্রতি ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০টি পণ্য বেশি উৎপাদন করার দক্ষতা রয়েছে তাদের। তাই পণ্যের দাম কম রাখার সক্ষমতাও রয়েছে তাদের। যেমন—চীনা ফোন বাজারে আসার পরই কমতে থাকে দাম। তবে দামে কম হলেও পণ্যের মানের ক্ষেত্রে মোটেও কম নয়।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বুলেট ট্রেন চীনে রয়েছে। নির্মাণ দক্ষতার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন বড় নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বও এখন চীনের হাতে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজও করেছে চীন। বর্তমানে পৃথিবীর বিদ্যুৎ চাহিদার ২৫ শতাংশ চীন একাই উৎপাদন করে। বিশ্বের ৫০ শতাংশ কয়লা ও ৫০ শতাংশ স্টিল উৎপাদনেও চীন শীর্ষে। পৃথিবীর ৩৫ শতাংশ আপেল ও ১৩ শতাংশ সোনা উৎপাদন করে চীন। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ খেলনাও চীনের তৈরি—যা তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
১৯৯০ সালে যেখানে বৈশ্বিক বাজারে চীনা পণ্যের অংশ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, আজ সেটি দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। অর্থাৎ রপ্তানিতে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ হলো চীন।
চীনের উন্নতির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। ফলে বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানি সে দেশে তাদের কারখানা স্থাপন করার সাহস পাচ্ছে। দামে সস্তা হওয়ায় কৃষিযন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাত এবং শিল্পকারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চীন থেকেই আমদানি করা হয়।
চীনের উন্নতির আরেকটি কারণ হলো—তারা সবসময় নিজেদের তৈরি পণ্য ব্যবহার করে। তারা ইউটিউব কিংবা ফেসবুক ব্যবহার করে না। চীনারা তাদের দেশের তৈরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। এছাড়া আমরা যেখানে গুগলে সার্চ করি, তারা সেখানে নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে। তারা মোটেও চায় না যে তাদের কোনো তথ্য অন্য দেশের হাতে পৌঁছে যাক।
পৃথিবীর সর্বাধুনিক সুবিধা-সম্বলিত হাইওয়ে, ফ্লাইওভার ও সেতু চীনের রয়েছে। আর ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থাও আছে—যা ব্যবসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এটি চীনকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে।
এক সময়ের দুর্বল দেশটি আজ সামরিক শক্তিতেও অনেক এগিয়ে। তাই সামরিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রও চীনের ভয় পায়।
আমরা কতটা চীনের উপর নির্ভরশীল? আমাদের ব্যবহারের বেশিরভাগ ইলেকট্রনিক সামগ্রী—মোবাইল, লাইট, ফ্যান, চার্জার, হেডফোন ইত্যাদি—সবই চীন থেকে আমদানি করা হয়। তাছাড়া খাদ্যসামগ্রীও রপ্তানি করছে দেশটি।
চীনের এই সফলতার গল্পকে পুঁজি করে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে একদিন হয়তো বাংলাদেশও অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে যাবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
মন্তব্য করুন