মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

বাংলা বর্ষপঞ্জির বিবর্তন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৭ এএম

বিশ্বজিৎ দত্ত ভৌমিক:

মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির সাথে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি একত্রিত করে তৈরি করেছিলেন বাংলা ক্যালেন্ডার। এতে পণ্ডিতরা সূর্য, চাঁদ ও গ্রহের চক্র পর্যবেক্ষণ এবং গণনা করে সময় রাখার চেষ্টা করতেন। এই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাঙালিদের কাছ থেকে ভূমি কর আদায় করা হতো।

হিজরি বর্ষপঞ্জি এক বছর ৩৫৪.৩৭ দিন বিশিষ্ট ১২টি চান্দ্র মাস নিয়ে গঠিত। এই বর্ষপঞ্জি ইসলামি ছুটির দিন ও অনুষ্ঠানের সঠিক দিবস নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। যেমন রোজা রাখার সময়কাল ও হজ্জ করার সঠিক তারিখ। প্রতিটি মাস শুরু হয় নতুন চন্দ্র চক্রের আগমনে। ঐতিহ্যগতভাবে এটি চাঁদের অর্ধচন্দ্রের প্রকৃত পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে আগের মাস শেষ হয়। ফলস্বরূপ চাঁদের দৃশ্যমানতা, পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় অবস্থান ও আবহাওয়ার অবস্থার উপর নির্ভর করে প্রতি মাসে ২৯ বা ৩০ দিন থাকতে পারে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় চান্দ্র পঞ্জিকা পদ্ধতিতে মাসগুলি শুরু হয় চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে যখন সবচেয়ে সরাসরি অবস্থানে থাকে। মাসকে পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিণ করার গড় সময় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যা ২৯.৫৩ দিন। নিয়মানুযায়ী ৩০ দিন এবং ২৯ দিনের মাস। পরপর দুই মাস যোগ হয়ে ৫৯ পূর্ণ দিনে পরিণত হয়। এটি শুধুমাত্র ৪৪ মিনিটের একটি ছোট মাসিক উদ্ধৃত রেখে দেয় যা ২.৭৩ বছরে জমতে জমতে মোট ২৪ ঘণ্টা হয়। হিসাব নিষ্পত্তি করার জন্য চন্দ্র বর্ষপঞ্জিতে প্রতি তিন বছরে একটি দিন এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে চার বছরে একটি দিন যোগ করা হয়।

বর্ষপঞ্জি সৌর কৃষি চক্রের সাথে মিলতো না। তাই মুঘল সম্রাট আকবর রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ শিরাজিকে চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ও সৌর বর্ষপঞ্জিকে একত্রিত করে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন। এটি ফসলি সন বা ফসলি বর্ষপঞ্জি নামেও পরিচিত। ফসল কাটার কর বছরের সময় সম্রাট আকবর এটি গ্রহণ করেছিলেন।

আকবরের যুগে বর্ষপঞ্জিটিকে তারিখ-ই-ইলাহি বলা হত। এতে মাসের প্রতিটি দিনের আলাদা নাম ছিল। মাসগুলোর নামও ছিল আলাদা। আকবরের নাতি শাহজাহান রবিবার থেকে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহ ব্যবহার করার জন্য বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন ও বিদ্যমান শক বর্ষপঞ্জির মাসের নামের সাথে মিল রাখতে মাসগুলোর নাম পরিবর্তন করেন। এই বর্ষপঞ্জিই আমাদের ব্যবহৃত বর্ষপঞ্জির ভিত্তি।

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার সৌর সিদ্ধান্ত মেনে চলে। এটি গাণিতিক বর্ষ পঞ্জিকা। ইসলামি বর্ষপঞ্জি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় চান্দ্র পঞ্জিকায় সৌরবর্ষের কোনো হিসাব নেয় না। আর এই দুই বর্ষপঞ্জির পদ্ধতি ঋতুর সময় গণনা করার ক্ষমতা নেই।

তাই ১৯৫৪ সালে বাংলা ক্যালেন্ডারে সূর্য সিদ্ধান্তে বর্ষগণনারীতি পরিহার করে সায়ন সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করা হয়। এতে বারো মাসের দৈর্ঘ্য স্থির করে দেয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা কমিটি। প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিকার আমূল পরিবর্তন করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে পঞ্জিকা সংস্কার করার প্রস্তাব দেন। এই কমিটিই প্রস্তাব করে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস হবে ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস হবে ৩০ দিনে। তবে অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে। এতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় চান্দ্র পঞ্জিকা বিষয়টি বহাল ছিল। ফলে সরকারি সব কাজের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক আচার এই ক্যালেন্ডার মেনে চলতো।

১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ কমিটি গঠন করে। এই কমিটি মেঘনাদ সাহার সুপারিশ প্রাধান্য দিয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে। বাংলারীতি অনুযায়ী সূর্যোদয়ে দিনের সূচনা হয়। এই কমিটি আধুনিক গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিরীতি অনুসারে মধ্যরাত্রি থেকে দিনের সূচনা করা অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়।

১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে তৎকালীন এরশাদ সরকার। ফলে বাংলা ক্যালেন্ডার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়টি ছেদ পড়ে। এই ক্যালেন্ডার মেনে সরকারি কাজ চললেও ধর্মীয় ও সামাজিক কাজের জন্য আগের ক্যালেন্ডার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা পড়ে। এতে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় বাংলা ক্যালেন্ডার। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ও বাংলা বর্ষপঞ্জির বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূর করতে গিয়ে বাংলা দুই ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে চলছে দেশের মানুষ।

বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কারে ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদ কমিটিও আগের দুই কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ২০টি সুপারিশ দেন। তবে এতে চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুনকে অধিবর্ষের মাস গণনা করা। যা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে ফেব্র“য়ারি মাস। অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করা হবে।

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে অসামঞ্জস্য দূরীকরণ, পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক করা এবং জাতীয় দিবসগুলো মূলানুগ (মূল অংশের বা আদি রূপের সঙ্গে সংগতিসম্পন্ন) করতে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে তৃতীয়বার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি করা হয়। এই কমিটির প্রস্তাব ছিল বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস ৩১ দিনে, কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র মাস ৩০ দিনে এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে। অধিবর্ষ হবে ফাল্গুন মাসে, সে মাস হবে ৩০ দিনে।

চান্দ্র বর্ষপঞ্জি মেনে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা হয়। হিন্দুদের বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশনসহ যাবতীয় সামাজিক আচার এবং পূজা-অর্চনায় বাংলা মাসের দিনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া বাঙালী সংস্কৃতির উৎসব পার্বণ- পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখও বাংলা মাস নির্ভর।

লেখক: সাংবাদিক, বৈশাখী টেলিভিশন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
‎আগামী সাপ্তাহে ফ্যাসিস্ট  খুনি শেখ হাসিনার বিচার হবে 
‎আগামী সাপ্তাহে ফ্যাসিস্ট  খুনি শেখ হাসিনার বিচার হবে 
রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবৈধ সুবিধা দিলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবৈধ সুবিধা দিলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
৪৮ হাজার পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
৪৮ হাজার পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
বাতিল হলো ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান
বাতিল হলো ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিধান