মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার গ্যারি সোবার্সের জন্মদিন আজ

বৈশাখী ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৮:২৯ এএম
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৬ এএম

তাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার! এটাই তাঁর পরিচয় এবং এটুকুই যথেষ্ট। স্যার গারফিল্ড অউব্রান সোবার্স। তিনি গ্যারি সোবার্স নামেই বিশ্বে পরিচিত। ক্রিকেট মাঠে যে মানুষটা সবকিছু পারতেন। আজ ২৮ জুলাই, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান এই কিংবদন্তি সোবার্সের ৮৯তম জন্মদিন।

গারফিল্ড সোবার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত ৯৩ টেস্ট খেলে রান করেছেন ৮,০৩২; গড় ৫৭.৭৮-যা টেস্ট ইতিহাসে ৫,০০০ রানের বেশি করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে পঞ্চম সর্বোচ্চ। বল হাতে নিয়েছেন ২৩৫ উইকেট, গড় ৩৪.০৩। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৮৩ ম্যাচে করেছেন ২৮ হাজারের বেশি রান, উইকেট নিয়েছেন এক হাজারের বেশি। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে খেলেছেন সাউথ অস্ট্রেলিয়া ও নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে। ক্রিকেটে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৫ সালে নাইট উপাধিতে ভূষিত হন।

বৈবাহিক সূত্রে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান এই কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পান ১৯৮০ সালে। ১৯৯৮ সালে বার্বাডোজের সংসদে একটি আইনের মাধ্যমে সোবার্সকে দেশের ১১ জন জাতীয় বীরের একজন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তাঁকে ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করে।

সোবার্স-দর্শনের অভিজ্ঞতায় বিশ্ব ক্রিটের রথি মহা রথিরা যা বলছেন- এভারটন উইকস, কিংবদন্তি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান : আমি গ্যারি সোবার্সকে চিনি ওর বয়স যখন ১২, তখন থেকে। বারবাডোজে বড় হচ্ছিল তখন। আমি তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে নতুন। এর কিছুদিন পরেই ও আমাদের ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়ল, তখন সবে ১৭। ওর কথা মনে আছে, বলছিল, ‘ফিল্ডিং করাটা বরং সহজ, ড্রেসিংরুমে নামজাদা খেলোয়াড়দের পাশে বসে থাকতে বেশি নার্ভাস লাগছে।’ তাকে কিছু শেখাতে হয়নি আমাদের। ও নিজেই নিজেকে শিখিয়ে ফেলল। রান করল, উইকেট নিল, ক্যাচ ধরল। ধীরে ধীরে নার্ভাসনেস উধাও হয়ে গেল। একবারই একটা টিপস দিয়েছিলাম ওকে। ইংল্যান্ডে এক ম্যাচে আমি আর সোবার্স একসঙ্গে ব্যাট করছিলাম। তখনকার দ্রুততম পেসার ফ্র্যাঙ্ক টাইসন বল করছিল। গ্যারির ব্যাক লিফট অনেক উঁচু ছিল। আমি বললাম, ‘সাবধান, ও (টাইসন) কিন্তু তোমাকে ইয়র্কারে তুলে নেবে।’ হ্যাঁ, সে টিকে গিয়েছিল।

ইয়ান চ্যাপেল, সাবেক অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক: অনেকেই ভাবে, সোবার্স বুঝি সহজাত প্রতিভা, এমনিই খেলে যেতেন, খুব বেশি ভাবতেন না। কিন্তু না, তিনি খুবই চিন্তাশীল খেলোয়াড় ছিলেন। সিডনির মোসম্যান ক্লাব একবার কোচ খুঁজছিল। ক্লাব প্রেসিডেন্ট গ্যারির সঙ্গে ডিনারে গিয়ে বললেন, ‘গ্যারি, আপনাকে কোচ হিসেবে চাই আমরা, কিন্তু আপনার তো কোনো কোয়ালিফিকেশন নেই।’ গ্যারি বলেছিল, ‘তোমার কী মনে হয়, আমি নাইটহুডটা কী কারণে পেয়েছি?’ আমার যখন ১৮, ব্যাটিং নিয়ে ওঁর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম। বললাম, ‘গ্যারি, মনে হচ্ছে কিছু সমস্যা হচ্ছে। কোনো টিপস আছে?’ গ্যারি বললেন, ‘আগে এক বোতল বিয়ার নিয়ে আসো বাবা, তারপর কথা বলি।’ তিনি আমাকে তিনটা টিপস দিয়েছিলেন, যেগুলো পুরো ক্যারিয়ারে অনুসরণ করেছি। প্রথমত, মিডল নয়, লেগ স্টাম্প গার্ড নিতে। কারণ, আমি তাঁর মতো ব্যাক অ্যান্ড অ্যাক্রস খেলতাম। দ্বিতীয়ত, ক্রিজ থেকে একটু বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যাটিং করতে। তৃতীয়টা মনে নেই এখন, তবে সেটাও খুব কাজে লেগেছিল। আরেকটা দারুণ গল্প বলি। একবার ইংল্যান্ড সফরে জিওফ বয়কট এসে সোবার্সকে বললেন, ‘গ্যারি, তুমি আমাকে বারবার এলবিডব্লু কর, বুঝি না কীভাবে!’ সোবার্স উত্তর দিলেন, ‘অনেকেই ভাবে তোমার টেকনিক ভালো, কিন্তু আমি তা মনে করি না। তোমার সামনের পা বেশি দূর চলে যায় এবং আড়াআড়ি হয়ে যায়। তাই ব্যাট প্যাডের পাশে আনতে পারো না। আমার ইনসুইং তোমাকে এলবিডব্লু করে দেয়।’ পরদিন মাঠে দেখা। বয়কট ব্যাটিং করছেন। গ্যারি দৌড়ে এসে প্রথম বলটা করলেন। বাইরের দিকে অ্যাঙ্গেল করা। বয়কট ক্যাচ তুলে দিলেন স্লিপে। বয়কট যখন ফিরে যাচ্ছেন, গ্যারি হেসে বললেন, ‘জিওফ্রে, তুমি কিন্তু আমাকে অন্যটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করোনি!’

ইয়ান ম্যাকডোনাল্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কবি, ঔপন্যাসিক ও কলাম লেখক: মাঠে সোবার্সকে দেখেছি এক অপার বিস্ময় হিসেবে। টেক্সটবুক ছাড়িয়ে কল্পনার ব্যাটিং, বৈচিত্র্যময় বোলিং—পেস, সুইং, স্লো, চায়নাম্যান—আর উইকেটের আশপাশে বিদ্যুৎগতির ফিল্ডিং। ও যেন এক অতুলনীয় জীবনীশক্তি, যার দিকে সব চোখ নিজে থেকেই ঘুরে যেত। কিন্তু আমি তাকে মনে রাখি আরও একটা কারণে—জীবনকে যেভাবে সে উপভোগ করত, তারুণ্যের আগুন তাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলত। বৌর্ডায় এক টেস্ট ম্যাচের মাঝরাতে একটা পার্টি। রাত তিনটার দিকে পার্টি শেষ হলো। সবাই হোটেলে ফিরছে। কিন্তু সোবার্স তো চুপচাপ বসে থাকার মানুষ না! কেউ একজন বলল, ‘একটা নতুন জায়গা খুলেছে—দ্য ক্রিমসন ক্যাবেজ।’ সোবার্স সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘কেউ জায়গার নাম বলবে, আর আমি সেখানে যাব না, এমন হয় নাকি! এখনো সময় আছে, চলো একবার দেখি।’ খেলা শুরুর তখনো কিছুটা সময় ছিল। আর জীবনের নেট অনুশীলনও তো গুরুত্বপূর্ণ। কেউ চাইলে দেখে নিতে পারেন, পরদিন মাঠে সোবার্স ঝলমলে এক সেঞ্চুরি করেছিল অফসাইডে, অনসাইডে, মাথার ওপর দিয়ে, এমনকি এই নশ্বর জগতের বাইরেও বাউন্ডারি মেরে।

টেড ডেক্সটার, সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক : সাউথ অস্ট্রেলিয়া তখনো শেফিল্ড শিল্ড জেতেনি। টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচের আগে টিম মিটিং। একজন ব্যাটসম্যানকে কীভাবে আউট করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা। হঠাৎ এক কোণ থেকে ভেসে এল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কণ্ঠ, ‘ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও।’ এরপরের আলোচনা—ওই বোলারকে কীভাবে খেলব? আবার উত্তর এল, ‘চিন্তা করো না, আমি রান করে দেব।’ একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের মতোই গ্যারি কথা রেখেছিল—বড় একটা ইনিংস খেলল, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট, আবার কয়েকটা ক্যাচও! ম্যাচ শেষে হাসতে হাসতে বলল, ‘এত চিন্তা কেন তোমাদের, আমার ওপর আস্থা রাখো!

গ্লেন টার্নার, সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক: কাউন্টি ক্রিকেটে সোবার্সের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। একবার উস্টারশায়ারের বিপক্ষে খেলার সময় সে একটা বল তুলে মারল ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে—সোজা ফিল্ডারের হাতে। সোবার্স যখন ফিরছিল, আমাদের সতীর্থ বাসিল ড’অলিভেইরা বলল, ‘দেখো, ও ফিল্ডারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই বলবে, আরে তোমাকে তো দেখিইনি!’ পরে আমরা ফিল্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম—সে বলল, ঠিক এই কথাটাই বলেছে সোবার্স! নিজের ওপর তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। যখন প্রথম ইংল্যান্ডে এসেছিল, থাই প্যাড পরত না, বলত, ‘আরে, ব্যাটটা আছে কিসের জন্য আছে?’ কিন্তু ইংলিশ কন্ডিশনে বারবার থাইয়ে বল লেগে ব্যথা পাওয়ার পর সে প্যাড পরতে শুরু করেছিল। গ্যারির এমন অজস্র কাহিনি আছে। মাঠে যা পারত, মাঠের বাইরেও তাই। শুধু পার্থক্য এই, ও অসাধারণ সব কাজ করে ফেলতে পারত—আমরা পারতাম না

অ্যালান ডেভিডসন, সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার : ১৯৬০-৬১ সালের সিরিজে দুজন চমৎকার অধিনায়ক ছিলেন—ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ও রিচি বেনো। ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটের আনন্দেই। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ছিলেন রোহান কানহাই, কনরাড হান্ট, ওয়েস হল, ল্যান্স গিবস। কিন্তু যিনি সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি—গারফিল্ড সোবার্স। লোকটা ক্রিকেট মাঠে যা খুশি করতে পারত, শুধু আম্পায়ারিং বাদে। ব্যাটিং? বিধ্বংসী। ফিল্ডিং? অসাধারণ। বোলিং? সব ধরনের! বলার মতো নয়, সে যেভাবে খেলত—দুনিয়ার সেরা বোলারদের ধ্বংস করে দিত। ফিল্ডিং সেট করা যেত না ওর জন্য। যেখানে খুশি, সেখান দিয়েই রান তুলে ফেলত। ব্রিসবেনের সেই ঐতিহাসিক ‘টাই টেস্ট’-এ ও অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করল। শট সিলেকশন ছিল এককথায় অবিশ্বাস্য। দ্বিতীয় ইনিংসে আমি একটু অন্য রকম কিছু করার চেষ্টা করলাম। আগের কয়েক ওভারে ধীরে বল করছিলাম, তারপর হঠাৎ একটা জোরালো ইয়র্কার—বল ঢুকে গেল ওর ডিফেন্স ভেঙে। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। কারণ, ও ছিল সেই ব্যাটসম্যান, বোলাররা যার উইকেট পাওয়ার আশাই করত না। যখন কেউ আপনার সেরা বলটাকেও চার মেরে দেয়, ধরে নিতে হবে, আপনি আজ ধ্বংস হতে চলেছেন! গ্যারি ছিল সে রকম ব্যাটসম্যান।

জন বেনো, সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান : এখনো স্মৃতি টাটকা। এমসিজিতে বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে খেলছি, ইন্তিখাব আলম স্পিন করছিল। ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে ছিলেন সোবার্স। ইন্তিখাব বেশ বুদ্ধিমান লেগ স্পিনার ছিলেন। আমাকে একটা গুগলি দিলেন, আমি ভেবেছিলাম টপ স্পিন। ব্যাটের ভেতরের কানা ঘেঁষে বল গেল। সোবার্স ঠিক আমার কাঁধের কাছাকাছি, নিচু হয়ে এক হাতে বলটা ধরে ফেললেন—দারুণ ক্যাচ! সেই ম্যাচেই তিনি অস্ট্রেলিয়ান বোলিং ধ্বংস করেছিলেন ২৫৪ রানের ইনিংসে। দুটি স্মৃতি মনে গেঁথে আছে। একটি, ডেনিস লিলির ইয়র্কারকে স্কয়ার ড্রাইভ করলেন! বলটা ওর জন্য চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কথা ছিল। কিসের কি! ড্রাইভ করে পাঠিয়ে দিলেন পয়েন্টে, বাউন্ডারি সীমানায় লেগে অন্তত ১৫ মিটার ভেতরে ফিরে এল! আরেকটা, বব ম্যাসি নতুন বল হাতে একটি দারুণ লেট ইন-ডিপার দিল। সোবার্স প্রথমে ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কবজির এক মোচড়ে বলটা পাঠালেন আমার আর টেরি জেনারের মাঝখান দিয়ে, মিড অন আর মিড উইকেটের মাঝে দিয়ে সোজা চার! অসাধারণ রিফ্লেক্স রেসপন্স। তাঁর কবজির শক্তি ছিল অবিশ্বাস্য। একবার ভিক্টোরিয়া ক্লাবে গলফ খেলছিলাম আমরা। প্রথম হোলটা ছিল নিচের দিকে, পার ফোর। সোবার্স ১-আয়রন দিয়ে বলটা সরাসরি গ্রিনে তুললেন, যা প্রায় অসম্ভব! এমন এক অসাধারণ প্রতিভা ছিলেন সোবার্স।

ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, সাবেক ভারতীয় উইকেটকিপার : এমসিজিতে অস্ট্রেলিয়া-বিশ্ব একাদশ ম্যাচ। ডেনিস লিলি ব্যাট করতে এসেছেন ১১ নম্বরে। গ্যারি আমাকে বলল, ‘রুকি, একটু পেছনে যাও। আমি দেখাচ্ছি ওকে আসল ফাস্ট বোলিং কাকে বলে।’ টানা কয়েকটা বাউন্সার করল, তার পরের বলেই উইকেট! লিলি যেন প্রতিটা ডেলিভারিতে পালানোর চেষ্টা করছিল। ড্রেসিংরুমে ফিরে লিলি গ্যারিকে বলল, ‘দেখা হবে।’ গ্যারির জবাব, ‘আমি তো অপেক্ষা করছি।’ তারপরই ও খেলল ২৫৪ রানের সেই ইনিংস।

গ্যারি সব সময় লড়াই ভালোবাসত। একবার ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে ব্যাট করছিলাম, প্রতিপক্ষ ছিল গ্যারির দল নটিংহ্যামশায়ার। তখন বল পুরোনো হয়ে গেছে, বেশ সহজেই মারছিলাম। হঠাৎ নতুন বল নিল ওরা, আর গ্যারি বল করতে এল। তখন এক রান হলেই ২০০, তখন ২০০ করলে বোনাস পয়েন্ট মিলত। গ্যারি ছয়টা বলই করল অসাধারণ লেফট-আর্ম আউটসুইং। লয়েড তখন সম্ভবত সত্তরের ঘরে ব্যাট করছিল। একটাও ব্যাটে লাগাতে পারল না।

ব্যারি জারম্যান, সাবেক অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার : ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাডিলেড ওভালে সাউথ অস্ট্রেলিয়া-ভিক্টোরিয়া ম্যাচ। আমি সাউথ অস্ট্রেলিয়া দলে। আগের দিন ভিক্টোরিয়ার উইকেটকিপার রে জর্ডানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্রচণ্ড গরম, বিয়ার খাচ্ছি। জর্ডানকে আমরা ডাকতাম ‘স্লাগ’ নামে। সে বলল, ‘জার, একটা কথা বলি?’ বললাম, ‘কী?’ সে বলল, ‘আমার মনে হয়, সোবার্স অত বড় কিছু না, ওভাররেটেড।’ কীভাবে যেন গ্যারি এই কথাটা জেনে গেল। ভিক্টোরিয়া টস জিতে ব্যাটিং নিল, আমরা ১০১ রানেই অলআউট করে দিলাম। সোবার্স নিল ৩ উইকেট। তারপর নিজে ব্যাটিংয়ে নেমে করল ১২৪ রান। আবার বল হাতে ৬ উইকেট। সাউথ অস্ট্রেলিয়া জিতল ইনিংস ও ৪৬ রানে, মাত্র তিন দিনের মধ্যে! একাই জিতিয়ে দিল পুরো ম্যাচ। এর পর থেকে দেখা হলেই আমি যখন ডাক দিতাম, ‘স্লাগ, শোনো তো…।’ সে মুখ ফিরিয়ে চলে যেত, বলত, ‘আমাকে ছেড়ে দাও।’

আরেকটা মজার ঘটনা—ভিক্টোরিয়ার অধিনায়ক বিল লরি এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। কেউ প্রশ্ন করল, ‘এই সাউথ অস্ট্রেলিয়া দলটা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?’ লরি বললেন, ‘ওরা একজনের দল।’ তখন জন লিলের স্ত্রী রোজমেরি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মিস্টার লরি, তাহলে কি ধরে নেব এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানই ১১ জন ভিক্টোরিয়ানের চেয়ে ভালো?’

মার্ক নিকোলাস, ধারাভাষ্যকার ও হ্যাম্পশায়ারের সাবেক অধিনায়ক : ১৯৬৮ সালে প্রথমবার নটিংহামে এলেন গ্যারি সোবার্স। দলের খেলোয়াড়েরা ওঁকে দেখল ম্যাচের আগের দিন—অথচ তিনিই ছিলেন অধিনায়ক। প্রচণ্ড ঠান্ডা, প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি দিয়ে নামলেন ভেড়ার চামড়ার কোটে নিজেকে জড়িয়ে। সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১০ মিনিট দেখলেন, তারপর চলে গেলেন।

পরদিন সকালে ম্যাচের এক ঘণ্টা আগে হাজির। চেঞ্জ করে, দুটো জাম্পার গায়ে চাপিয়ে একটু স্ট্রেচ করলেন, এরপর টসে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘আমরা বোলিং করব।’ তিনিও বোলিংয়ে নামলেন। ৩ উইকেট নিলেন খুব কম রান দিয়ে। লক্ষ্য তেমন বড় কিছু নয়, কিন্তু তাড়া করতে গিয়ে দল পড়ে গেল বিপদে—১৭০-এর মতো রান তাড়া করতে নেমে ৫০ রানে ৩ উইকেট। সোবার্স তখন হাঁটতে হাঁটতে নামলেন, সামনে ইংল্যান্ডের সেরা পেস আক্রমণ: হিগস, স্ট্যাথাম, শাটলওয়ার্থ, লেভার আর উড। তিনি করলেন ৭৫ রান, অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়ে এলেন, তখনো ১০ ওভার বাকি। ম্যান অব দ্য ম্যাচ ট্রফি নিতে গেলেন, তারপর ড্রেসিংরুমে ফিরে বললেন, ‘ভালো খেলেছ সবাই। আচ্ছা, পরের ম্যাচটা কার বিপক্ষে?’ মাইক টেলর বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু তাকিয়ে ছিলাম বিস্ময়ে..’

জন পারকিন, নটিংহ্যামশায়ারের সাবেক ব্যাটসম্যান : সোবার্সের ছয় ছক্কার সময় নন-স্ট্রাইক প্রান্তে ছিলেন সেন্ট হেলেন্স, সোয়ানসিতে ছয় ছক্কা মারার পর আমরা গেলাম বারে। সেখানে গ্ল্যামারগনের কমিটি সদস্যরা ওকে ঘিরে ধরেছে। সবাই একটুখানি কথা বলতে চায়, ছয় ছক্কা নিয়ে মন্তব্য চায়। কিন্তু গ্যারি পাবলিসিটি একদম পছন্দ করত না। ও আমাকে বলল, ‘চলো, পুরোনো বারে ফিরে যাই।’ গ্যারি বিশ্ব রেকর্ড নিয়ে মাথা ঘামাত না, ও চেয়েছিল খেলাটা খেলতে। কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি ওর ধাতে ছিল না। সরল জীবন, খেলা উপভোগ করা—এটাই ছিল তার দর্শন। এই সরলতাটাই ছিল ওর আসল মাহাত্ম্য।

মাইক প্রক্টর, সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার : গ্যারি অসাধারণ মানুষ। ১৯৭০ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ড বনাম রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডের প্রথম টেস্ট—গ্যারিই আমাদের অধিনায়ক। খুবই স্বতঃস্ফূর্ত, সহজাত। সেদিন অসাধারণ খেলল সে—১৮০ রানের ওপরে করল, সঙ্গে ৮টা উইকেট! কাউন্টিতে খেলতাম বলে ওকে আগে থেকেই চিনতাম, কিন্তু বিশ্বসেরা একাদশের বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স ছিল অবিশ্বাস্য। সিম, স্পিন—সব দিয়েই উইকেট নিল। আমরা ম্যাচটা জিতেও গেলাম। সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার? ম্যাচ শেষে গ্যারির কথা—‘ঠিক আছে, ট্রেন্ট ব্রিজে দেখা হবে।’ মনে হচ্ছিল, যেন কিছুই হয়নি। ওভালে শেষ টেস্টে, টার্নিং উইকেট, লক্ষ্য ২০০-এর বেশি, ২০ রান বাকি। আমি ওর সঙ্গে শেষ দিকে ব্যাট করতে নামি। কঠিন উইকেট, ভয়াবহ স্পিন, কিন্তু গ্যারি এতটাই স্বাভাবিক খেলছিল! বাড়তি কিছু না, শটের বাড়াবাড়ি না—যা দরকার, সেটুকুই। ম্যাচ জেতাল, মাঠ ছেড়ে গেল। ওর মানসিকতা ছিল অবিশ্বাস্য।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) টিভিতে যেসব খেলা দেখবেন
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) টিভিতে যেসব খেলা দেখবেন
বিসিবির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেন রুবাবা
বিসিবির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেন রুবাবা
প্রথমবার নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতলো ভারত
প্রথমবার নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতলো ভারত
এবারের বিপিএলে দল পাচ্ছে না নোয়াখালী ও খুলনা
এবারের বিপিএলে দল পাচ্ছে না নোয়াখালী ও খুলনা