বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

সেলিম আল দীনের জন্মদিন আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৬ এএম
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম

আজ নাট্যাাচার্য সেলিম আল দীনের জন্মদিন। শিল্প-সাহিত্যের পথপরিক্রমায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের পথ ধরে হেঁটেছেন সেলিম আল দীন। সমকালীন শিল্প নন্দনে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরে হাজার বছরের বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যের বিকাশে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন সেলিম আল দীন। আজ ১৮ আগস্ট তাঁর ৭৬তম জন্মবার্ষিকী।

১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সেলিম আল দীন। পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ ও মা ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেলিম। প্রথম লেখাপড়ার শুরু আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে। কিছুদিন পর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তারপর মৌলভীবাজারের বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারি স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৪ সালে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

সেলিম আল দীন বাংলার গ্রামগঞ্জে পালা, জারি, যাত্রাগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীরভাবে। নানা আঙ্গিককে তুলে এনে সমকালীন বৈশ্বিক রুচিবোধের অনুকূলে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে রচনারীতিসহ সামগ্রিকতায় তিনি বাঙালির বহমান রীতিকেই গ্রহণ করেছিলেন।

সহপাঠী বন্ধুদের চাপে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম নাটক লেখেন। নাটকই হয়ে ওঠে তাঁর পথ চলার প্রধান বাহন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সেলিম আল দীন নিজস্ব এক নাট্যরীতির অনুসন্ধান চালিয়ে যান। তবে নাট্যকার হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ গবেষণা নানা ক্ষেত্রেই তাঁর ঐতিহ্যবিকাশী প্রবণতাই প্রধানরূপে লক্ষণীয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন, কথা সুর।তার রচিত নাটকগুলোর প্রথম পর্যায়ে নিরীক্ষা থাকলেও পরবর্তী রচনাগুলোর সবই বাঙলার নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির রূপে পরিপুষ্ট। ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি অতীতে বাস করেননি।

নাটক লেখার শুরুর দিকে তিনি বাংলার প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংগ্রামের চিত্র বর্ণনা করেছেন। ‘করিম বাওয়ালির শত্রু’ অথবা ‘মূল মুখ’ দেখা নাটকে মৌচাকের মধু সংগ্রহের পেশানির্ভর জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। তেমনি ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’ নাটকের মধ্যে সেলিম আল দীন এ দেশের জনসমাজের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। চাষিদের সংগ্রাম, মহাজনী প্রথাসহ প্রান্তিক জীবনের নানা বিষয় তাঁর এ নাটকে বিদ্যমান।

‘শকুন্তলা’ নাটকে প্রাচীন বাঙালিত্বের স্বাদ পেয়েছে দর্শক। বাঙালির ‘মেলা’ সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে সেলিম আল দীন রচনা করেছেন ‘কীর্তনখোলা’ নাটক। সংস্কৃতির নানা দিক এতে ফুটে উঠেছে। যেখানে সেলিম আল দীন মূলত হাজার বছরের বহমান বাংলা সংস্কৃতির গভীর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষা করেছেন। ‘কীর্তনখোলা’ নাটকের শুরুতেই অষ্টাদশ শতকের বাঙলার জনপ্রিয় ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার বন্দনার নিরিখে বন্দনা করেছেন।বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যযুগের সুপরিচিত ধারা মঙ্গলকাব্য। মাঙ্গলিক চিন্তন বিন্যাসের রূপায়ণ তার ‘কেরামতমঙ্গল’ নাটক। কেরামতের জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এ নাটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সমাজ, সভ্যতা ও বাস্তবতাকে।

সমুদ্র উপকূলবর্তী আঞ্চলিক মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর ‘হাত হদাই’ নাটক। এ নাটকে বাংলার আঞ্চলিক জীবন ফুটে উঠেছে। সেলিম আল দীনের কথা নাট্যরীতির আরেকটি নিরীক্ষাধর্মী ‘যৈবতী কন্যার মন’। এ নাটকেও তিনি ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যধারাকে বিকশিত করেছেন

‘চাকা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪ সালে এবং ‘কীর্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে। ‘একাত্তরের যীশু’ চলচিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সেলিম আল দীনের উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা) ; নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ, কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (‘একাত্তরের যীশু’, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫ সহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে সেলিম আল দীনের সঙ্গে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার বিয়ে হয়। একমাত্র সন্তান মঈনুল হাসানের অকালমৃত্যুর পর থেকে সেলিম আল দীন ছিলেন নিঃসন্তান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে যেই মানুষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি হচ্ছেন সেলিম আল দীন। বিভিন্ন উৎসবের মূল বাণী ঠিক করে দেওয়া, অনুষ্ঠানের আমেজ অনুযায়ী গান তৈরি করাসহ সবই করতেন। সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাটিতেই অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে আছেন।সেলিম আল দীন জীবনকে যেমন করে চিনেছিলেন, মৃত্যুকেও তেমনিভাবে চিনতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি নাটকে তিনি কোনো এক অধরা পৃথিবীর অচিনলোকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন; সেলিম আল দীন হাসতে হাসতে মানবজীবনের কঠিন সত্যকে তুলে ধরতে পারতেন। বেঁচে থাকতে যেমন করে নতুন কিছু করার সদা তৎপরতায় বিভোর থাকতেন, মৃত্যুটাও তাঁর তেমনই। যেমন ‘ধাবমান’ নাটকে তিনি লিখেছেন ‘সে মৃত্যু কষ্টজয়ী হোক, সে দুঃখ জয়ী হোক/ শোক পারায়ে যাক সবল পায়ে...।’

এদিকে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী ‘নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মোৎসব ২০২৫’ করছে নাট্যসংগঠন স্বপ্নদল। ‘সেলিম আল দীন-রবীন্দ্রনাথ মোদের শিল্পে রয়, বাঙলা নাট্যের জয়যাত্রা অনন্ত-অক্ষয়’-স্লোগানে আজ সোমবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে উৎসবের পর্দা উঠবে; পর্দা নামবে আগামীকাল মঙ্গলবার।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বপ্নদল জানিয়েছে, উৎসবে হরগজ ও চিত্রাঙ্গদার বিশেষ প্রদর্শনী করবে নাট্যসংগঠনটি। প্রযোজনা দুটির নির্দেশনা দিয়েছেন নাট্যাচার্যের ছাত্র, নির্দেশক জাহিদ রিপন। এ ছাড়া স্মরণ-শোভাযাত্রা, নাট্যাচার্যের সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ, নাট্যাচার্যের জীবন-কর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনাও থাকবে। আজ সকাল ১০টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন থেকে নাট্যাচার্যের সমাধি অভিমুখে স্মরণ-শোভাযাত্রা ও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হবে। সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে সেলিম আল দীনের কালজয়ী সৃষ্টি হরগজ–এর ৪৯ তম প্রদর্শনী হবে।

১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জ জেলার হরগজে সংঘটিত প্রলয়ংকারী টর্নেডোর অভিজ্ঞতা নিয়ে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন হরগজ রচনা করেন। নাটকটি টর্নেডোর পর উদ্ধারকারী দলের অভিজ্ঞতা ও আকৃতির জগৎ থেকে হঠাৎ নিরাকৃতির জগতে তাদের উপস্থিতি ও পরিণতি নিয়ে আবর্তিত। আগামীকাল সমাপনী দিন সন্ধ্যা ৭টায় এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার ১১৯ তম মঞ্চায়ন হবে।

‘সেলিম আল দীন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করলেও পরে বাকি জীবন শিক্ষকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।

তিনি ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘বনপাংশুল’, ‘চাকা’, ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’, ‘পুত্র’ প্রভৃতি নাটক রচনা করেছেন। একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করলেও পরে বাকি জীবন শিক্ষকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মারা যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
নির্মাণ হলো বিশেষ নাটক 'স্বামীর আদর'
নির্মাণ হলো বিশেষ নাটক 'স্বামীর আদর'
বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষ কে এই জনাথন বেইলি
বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষ কে এই জনাথন বেইলি
বিএনপির দুঃসময়ের সাথী, স্বৈরাচারের জম রুমিন ফারহানা আপা: হিরো আলম
বিএনপির দুঃসময়ের সাথী, স্বৈরাচারের জম রুমিন ফারহানা আপা: হিরো আলম
যে ধরণের পুরুষ পছন্দ মালাইকার
যে ধরণের পুরুষ পছন্দ মালাইকার