
বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক রত্ন, বাংলাদেশি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার জহির রায়হান। শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। 'ওদের জানিয়ে দাও, ওরা আমার ভাই-বোনকে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে ওদের স্টিম রোলারের নিচে ওদের জানিয়ে দাও।' মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে লেখেন 'ওদের জানিয়ে দাও' নামের একটি কবিতা। প্রকাশ হয় চতুষ্কোণ পত্রিকায়। নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে লেখা সেই কবিতায় ফুটে ওঠে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সেই থেকেই তার জাত প্রতিভার পরিচয় মেলে।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালে ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। সেই হিসেবে জহির কলকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু'বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
চলচ্চিত্রে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে 'জাগো হুয়া সাভেরা' সিনেমায় সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তার কিছুদিন পরেই ১৯৬১ সালে 'কখনো আসেনি' সিনেমাটির মধ্য দিয়ে রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় তার। ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'কাঁচের দেয়াল' সিনেমাটির মাধ্যমে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা পেয়েছিলেন। তবে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি বাংলা চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া' সারা বাংলায় সাড়া ফেলে দেয়।
জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড' একটি জাতির অসীম ত্যাগের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির ক্ষেত্রে 'স্টপ জেনোসাইড' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশ হয়। তার রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১)। ১৯৬৪ সালে ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি নিগার পুরস্কার লাভ করেন। তার নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘বেহুলা’, ‘সঙ্গম’, ‘আনোয়ারা’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’। ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন।
চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি ‘যে নদী মরুপথেতে’ও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে ‘এ দেশ তোমার আমার’ এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন।
জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়াতে’। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন। মিরপুরে তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেককে বিহারিরা আটকে রেখেছে বলে খবর পেয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে তিনি সেনাবাহিনী ও পুলিশের বহরের সঙ্গে মিরপুর ১২ নম্বরের দিকে যান। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিহারিরা কালাপানি পানির ট্যাংকের সামনে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে তিনি নিহত হন। পরদিন ৩১ জানুয়ারি বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে মিরপুর দখলমুক্ত হলেও তার লাশ পাওয়া যায়নি।
জহির রায়হানের সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘খাপছাড়া’, ‘যান্ত্রিক’, ‘সিনেমা’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশ হয়। জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দার দুই ছেলে। আরাফাত রায়হান অপু ও তপু রায়হান। ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লা কায়সারের।ভাইয়ের মেয়ে শমী কায়সার।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামের এক অজ্ঞাতের টেলিফোন কল আসলো। টেলিফোনে জহির রায়হানকে জানানো হলো তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজ মিলেছে। বড় ভাইকে বাঁচাতে ছুটে গেলেন। সেই যে গেলেন এরপর আর জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাত্র ৩৭ বছরে জীবনের পরিধি টেনে নিখোঁজের তালিকায় রয়ে গেলেন বাংলার এই ক্ষণজন্মা সূর্যসন্তান। বাংলা মা পড়ে রইলো হাজার বছরের প্রতীক্ষায়।
মন্তব্য করুন