
‘ বাজী’ দিয়ে আবারও আলোচনায় এলেন সুরকার,গীতিকার ও কবি হাশিম মাহমুদ। ‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজী’ কিন্তু আগেও আলোচনায় ছিল। কয়েকজন শিল্পী এই গানে কন্ঠ দিয়েছেন। অবশ্য হাশিম মাহমুদের অনুমতি নিয়ে তারা গেয়েছেন কি না সেই প্রশ্নও উঠেছিল!
এর কারণ হাশিম মাহমুদ দীর্ঘদিন এসবের বাইরে ছিলেন। তার লেখা ও সুর করা যে সব গান ১৯৯৩-৯৮ সালেই আলোচিত হয়েছিল সে সব অনেক পরে মানুষ শুনেছে। তিন বছর আগে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছবি নিয়ে সারাদেশে যখন তোলপাড় চলছিল তখন হাশিম মাহমুদও আলোচনায় চলে আসেন। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ খ্যাত ‘তুমি বন্ধু কালাপাখি’ গান যখন সুপাহিট তখনও খানিক অসুস্থ এবং আলোচনার বাইরে ছিলেন হাশিম মাহমুদ। তার অনেক সহৃদয় ভক্ত তখন হাশিম মাহমুদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন,কামনা করেছিলেন- ভালোবাসার এই ‘হাওয়া’ যেন বয়ে যায়, যেন নিজস্ব ভূবনে হাশিম মাহমুদ তার গান নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে পারেন।
এরপর ‘দেখা না হলে বন্ধু কথা কইও না’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয় হয় এবং ফের আলোচনায় আসেন হাশিম মাহমুদ। যারা তাকে চিনতেন তারা জানতেন যে গানের নেশা ছিল তার কিন্তু টাকা গোনার বাজী বা নেশাটা ছিল না। হয়তো হাশিম সারারাত গান গেয়েছেন। কেউ তাকে ঠিকমতো খেতেও দেয় নি। গান গাইলে যে টাকা পাওয়া যায় সেই চিন্তাও ছিল না তার মাথায়। নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকার শাহবাগ, বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা বা ছবির হাটে আসার দিনগুলো ছিল অন্যের সাহায্য নির্ভর। আসতেন,দল বেধে গান গাইতেন, কখন খাবেন, খাবার টাকা কীভাবে জুটবে সেই চিন্তা তার মাথায় আসে নি। এই মাথায় না আসার পাপে যে জীবন যাপন করেছেন হাশিম সেই জীবন তাকে জীবন থেকেই নির্বাসন দিয়েছে। তিনি বহুদিন তার মতো একা একা জীবন কাটিয়েছেন মা ও বোনের সাথে, নারায়ণগঞ্জে।
বাজী গানটার কয়েক লাইন এমন- ‘একবার আমি গিয়েছিলাম পাহাড়ি অঞ্চল পাহাড়ি মেয়েটার চোখ দুটো ছল ছল ছল? নাকি জল? চঞ্চল? মেয়ে তুই বল তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি-এই বাজিতে কী জিতলেন বা হাশিম আদৌ কোনো বাজি ধরেছিলেন কিনা সেই প্রসঙ্গ আজ থাক। জীবনের সকল অসংলগ্নতা নিয়ে হাশিম ‘আড়াল’ খুঁজতে শুরু করেছিলেন এক যুগ আগে থেকেই। ১৯৯০-৯১ থেকেই গানের আড্ডা, গানের দল করা, নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে পরে থাকা,চাকরিতে মনসংযোগ করতে না পারা সব অভিজ্ঞতাই তিনি নিয়ে ফেলেছিলেন। তার অনভূতি এমন-‘ফিরে আসা এই দিন তার আনন্দেও নেই, দীর্ঘশ্বাসেও নেই!
মিডিয়ার কল্যানে হাশিম মাহমুদ আজ অনেক বেশি পরিচিত। কিন্তু অনেক আগে থেকে যে মানুষটা নিঃস্ব কিংবা নিঃসঙ্গ এক দ্বীপে বাস করেন,বিচ্ছিন্নতার ভাইরাল যাকে একাকী একজন হতে বাধ্য করে, গল্পের রিপভ্যান উইংকেলের মতো সে আর কখনো ফেরে না। জনপ্রিয়তার একটা ধূসর দিক আছে। জনপ্রিয়তার হিমালয়ে যখন বরফ জমে,যখন আলোচনার কোলাহল থেমে যায় তখন আর নীরবতার জল সেঁচা যায় না, পাল উড়ানো যায় না, তখন পুরোনো নিঃসঙ্গতা ফিরে আসে মারমুখো ঢেউ হয়ে। যে জীবন গীতিকবির, যে জীবন সুরকারের, যে জীবন গায়কের তার সাথে কখনো কী আর এমন দেখা হবে হাশিম মাহমুদের?
অনেকেই বলে থাকেন গানের জগতের সেরা সর্বহারাদের একজন হাশিম মাহমুদ। প্রতারক স্মৃতি আর জীবন ভরে পাওয়া নিদারুন অবহেলা ছাড়া আর কিছু নাই তার সম্পদ। যে আগুনে শুধু নিজের হৃদয় অঙ্গার হয় সেই আগুনটা দারুনভাবে চিনতেন হাশিম। তাই লিখতে পেরেছিলেন,গাইতে পেরেছিলেন সেই গান- ‘আগুন নিয়ে খেলছো তুমি আগুন চিনলা না!’
এই আগুন নিয়েই বাঁচুন হাশিম মাহমুদ। যে ভূবনে আছেন সেখানেই যেন থাকতে পারেন, সেই দেশান্তরেই যেন যেতে পারেন ঠিক আপনার গানের মতো- ‘আমি বাউল হইয়া হইলামরে দেশান্তর,ও দয়াল..আমি কান্দিয়া কান্দিয়ারে গেলাম’..
মন্তব্য করুন