মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫

 শাবানা আজমির জন্মদিন আজ

বৈশাখী ডেস্ক
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:১২ পিএম

বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা আজমির জন্মদিন আজ। আজ ১৮ সেপ্টেম্বর, ৭৫ বছরে পা দিলেন শাবানা আজমি। ১৯৫০ সালের আজকের দিনে হায়দরাবাদে জন্ম গ্রহণ করেন শাবানা আজমি। কবি কাইফি আজমি ও অভিনেত্রী শাওকত আজমির কন্যা শাবানা। ছোটবেলা থেকেই শিল্প ও সাহিত্য তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি কখনো পরিবারের আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করেননি। কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প ও নিয়মিত অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই তিনি নিজের পথ গড়েছেন।

শাবানার শৈশব ছিল ‘বোহেমিয়ান’। তিনি প্রায়শই বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে থাকতেন, যাঁরা তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তবে ছোট শাবানা বাবার পেশা পুরোপুরি বুঝতে পারতেন না। তিনি দেখতেন, বাবা অফিসে যান না, সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরেন না, বরং সাদা কটন কুর্তা-পাজামা ২৪ ঘণ্টা পরতেন। এই ‘অপ্রচলিত’ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শাবানা ধীরে ধীরে নিজেকে সামাজিক সচেতন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলেন। ছোটবেলায় বিশেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তিন মাস পেট্রোলপাম্পে দিনে ৩০ রুপি বেতনে কাজ করে কফি বিক্রি করে নিজের খরচ চালাতেন।

শুধু এ ঘটনা নয় তাঁর শৈশব ছিল দুঃখস্মৃতি-মিশ্রিত। ছোটবেলায় দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, ভাবতেন মা ভাই বাবাকে বেশি ভালোবাসেন। এই সংবেদনশীলতা তাঁকে পরবর্তী সময়ে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতেও প্ররোচিত।

শাবানা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করার সময় সিনিয়র ফারুক শেখের সঙ্গে একটি হিন্দি থিয়েটার গ্রুপ শুরু করেন। প্রথমবার সিনেমায় অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক জন্ম নেয় ‘সুমন’-এর জয়া ভাদুরি দেখার পর। বাবার অনুমতি নিয়ে শাবানা যোগ দেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াতে এবং ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেন। শেষ বছরের পড়াশোনার সময় খোয়াজা আহমদ আব্বাসের ‘ফাসলাহ’ ও কান্তিলাল রাঠোরের ‘পরিণয়’-এর প্রস্তাব পান। তবে শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’ এ অভিনয়ের মাধ্যমে সিনেমায় তাঁর অভিষেক হয়। সেই ১৯৭২ সালে করা প্রথম সিনেমায় জাতীয় পুরস্কার পান।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতীয় সিনেমার আধুনিক ইতিহাস লিখতে বসলে কয়েকজন অভিনেত্রীর নাম সবার আগে আসবে। তাঁদের মধ্যে অতি অবশ্যই শাবানা আজমি। তিনি শুধু পর্দার চরিত্রে অভিনয় করেননি, বিভিন্ন সময়ে যেন হয়ে উঠেছেন পুরো সমাজের কণ্ঠস্বর।

বলা হয়ে থাকে যে ৫০ বছর পর যখন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস লেখা হবে, তখন দেখা যাবে, প্রতিটি মোড়ে শাবানা আজমি উপস্থিত ছিলেন।’ সত্যিই তা-ই। ‘অঙ্কুর’ থেকে শুরু করে ‘আর্থ’, ‘মাসুম’ কিংবা ‘মকবুল’-প্রতিটি ছবিই যেন নারীর ভেতরের এক অজানা গল্প উন্মোচনের সাক্ষী।

নিজের ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে শাবানা আজমি বলেন আমি যখন শুরু করি, তখন সমান্তরাল বা আর্ট সিনেমা বলে কিছু ছিল না। সেই সময়েই নারী চরিত্রগুলো জটিলতর হতে শুরু করেছিল। আমি সেই ধারা বদলের সঙ্গী হতে পেরেছিলাম।

শাবানা হয়তো তথাকথিত ‘সুপারস্টার’ নন তবে অভিনয়ের দাপটে তিনিও ছিলেন নিজস্ব এক উচ্চতায়। তাইতো রাজেশ খান্না বলেছিলেন, ‘তিনি হয়তো সুপারস্টার নন, কিন্তু আবেগের সুপারস্টার।’

‘অমর আকবর অ্যান্থনি’-তে অভিনয় করেই শাবানা আজমি বুঝলেন, তিনি হিন্দি মেইনস্ট্রিম সিনেমার নাচ-গাননির্ভর নায়িকা হওয়ার মতো নন। দর্শকের সামনে তিনি সব সময়ই ভিন্নরূপে হাজির হতে চান। তাই আবার ফিরে গেলেন নিজের পছন্দের চরিত্রে।

যদিও বড় প্রযোজনার সিনেমায় শাবানা আজমি সব সময় ভিন্ন আভা ছড়িয়েছেন। সঠিক মেকআপম্যান, সহকারী আর সাজপোশাকে হাজির হতেন লোকেশনে। কিন্তু যখন মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’-এ অভিনয় করলেন, গিয়েছিলেন একেবারে একা-মেকআপ কিট আর কয়েকটা বই নিয়ে। চরিত্রের নীরবতা ও যন্ত্রণা নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্যই তাঁর এ একাকী প্রস্তুতি।

দিল্লিতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ আয়োজিত ‘নারী ও সিনেমা’ শীর্ষক সেমিনার বদলে দেয় শাবানা আজমিকে।ওই সেমিনারের শাবানার উপলব্ধি সফল অভিনেত্রী হওয়াটাই যথেষ্ট নয়; সমাজে নারীর কথা বলার দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় ‘আর্থ’, ‘মাসুম’, ‘ফায়ার’-এর মতো সিনেমার চরিত্র। যেখানে নারী নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়, নিজের সিদ্ধান্তে দাঁড়ায়।

রেখা বা হেমা মালিনীর মতো শাবানা আজমি কখনো কোটি টাকার পারিশ্রমিক পাননি। একেকটা সিনেমার জন্য পাঁচ থেকে ছয় লাখ রুপিই ছিল সর্বোচ্চ। অথচ ‘মণ্ডী’ সিনেমায় নিয়েছিলেন মাত্র ২০ হাজার টাকা। শেখর কাপুরের মতে, শাবানার কাছে টাকা কোনো দিনই বড় বিষয় ছিল না। চরিত্র যদি প্রিয় হয়, বন্ধুর সিনেমা জন্য হলে তিনি বিনা পারিশ্রমিকেও রাজি হতেন।

শাবানা ও স্মিতা পাতিল প্রায় একই সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি থেকে এসেছিলেন। এ কারণে কখনো কখনো তাঁদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্মে। পরে শাবানা স্বীকার করেন, স্মিতার সফলতা তাঁকে প্রাথমিকভাবে কিছুটা ‘বিক্ষুব্ধ’ করেছিল। তবে সময়ের সঙ্গে তিনি তা ভুল মনে করেন ও প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন।

কবি-চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার তাঁর জীবনের অপর নাম। শাবানা বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা দারুণ-বন্ধুত্বের ভেতরেই সবকিছু মিটে যায়। তাঁদের দাম্পত্য শুধু বিনোদনজগতের নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেও এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

শাবানা আজমি বলেন ‘কখনো কল্পনাও করিনি, ৫০ বছর পরও আমি কাজ করব। নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হয়। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় ছিলাম বলেই এত দূর আসা সম্ভব হয়েছে'। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের কথা স্মরণ করে শাবানা বলেন, ‘আমি যখন শুরু করি, তখন সমান্তরাল বা আর্ট সিনেমা বলে কিছু ছিল না। সেই সময়েই নারী চরিত্রগুলো জটিলতর হতে শুরু করেছিল। আমি সেই ধারা বদলের সঙ্গী হতে পেরেছিলাম। যদি সেই সময়টা না পেতাম, হয়তো সুযোগও পেতাম না।’

তাঁর ভেতরে কাজের ক্ষুধা এখনো প্রবল। নিজের প্রিয় চরিত্র কোনটি শাবানা বলেন ‘ওটা এখনো আসেনি। আমি কোথাও যাচ্ছি না!’ শাবানার কাছে সাফল্য মানে কেবল অর্থ বা জনপ্রিয়তা নয়। তিনি বলেন, কোনো সিনেমা ভালো করলে স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগে। কিন্তু ব্যর্থ হলে? তাতেও শিক্ষা আছে। অনেক সময় বাণিজ্যিক সাফল্য আসে না, তবু ছবিটা ইতিহাসে টিকে থাকে।

উদাহরণ হিসেবে শাবানা মনে করলেন গুরু দত্তকে। ‘কাগজ কে ফুল’ মুক্তির সময় ভয়াবহভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেও এখন সেটি এক কালজয়ী ছবি। নতুন কিছু করার সাহস থাকতে হবে।

শর্মিলা ঠাকুর একবার বলেছিলেন, শাবানা আজমি জন্মগত প্রতিভাবান। নিজের বুদ্ধি, কৌতূহল আর প্রস্তুতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্যারিয়ার গড়েছেন। প্রয়াত পরিচালক শ্যাম বেনেগালের মতে, ‘যত দিন শক্তি আর উদ্যম থাকবে, তিনি থামবেন না।

আর এখানেই শাবানা আজমির বিশেষত্ব। তিনি প্রচলিত ছাঁচে আটকে থাকেননি। নিজস্ব পথ বানিয়েছেন, নিজের সময়ে নারী জীবনের নতুন ভাষা তৈরি করেছেন। তাঁর চরিত্রগুলো আজও দর্শককে ভেবে দেখতে বাধ্য করে-নারীর ভেতরে কত স্তরের যন্ত্রণা, শক্তি আর প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে।

সমান্তরাল ধারা থেকে বাণিজ্যিক সিনেমা-সবখানেই শাবানা রেখেছেন নিজের শক্তিশালী ছাপ। অভিনয়ের স্বাভাবিক ভঙ্গি, চরিত্রের গভীরতা আর প্রচলিত ধারা ভেঙে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আজও তাঁকে সমীহ করেন দর্শক ও সহকর্মীরা। অভিনয়ের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনের কণ্ঠস্বর হিসেবেও তিনি ছিলেন নির্ভীক।

পাঁচ দশকের বেশি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক সিনেমাই করেছেন শাবানা আজমি। ভারতীয় গণমাধ্যম ডিএনএন সেখান থেকে বেছে নিয়েছে শাবানার ভিন্নধর্মী পাঁচ সিনেমা। মহেশ ভাট পরিচালিত ‘আর্থ’ ছবিতে শাবানা আজমির অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ বলে ধরা হয়। স্বামী কর্তৃক প্রতারিত নারী ‘পূজা’ চরিত্রে তিনি দেখিয়েছিলেন শক্তি, মর্যাদা ও আত্মসম্মানের লড়াই। নারীর স্বাধীনতা আর আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে নতুনভাবে তুলে ধরেছিল এই চলচ্চিত্র, যা আজও সমানভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক।

শাবানা আজমির অভিনয়জীবন শুরু হয় শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’ দিয়ে। গ্রামীণ জীবনের নিপীড়িত এক নারীর চরিত্রে তিনি ছিলেন নিঃশঙ্ক। ‘অঙ্কুর’ শুধু তাঁর অভিষেক নয়, ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার এক যুগান্তকারী সূচনা। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন।

মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’ নিঃসঙ্গতা, বিলীন হতে থাকা প্রথা আর অপূর্ণ প্রেমের গল্প। ছবির কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে শাবানা আজমির সংযত অথচ গভীর অভিনয় এই চলচ্চিত্রকে ক্ল্যাসিকের আসনে বসিয়েছে। নিঃশব্দে তিনি এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন ভাঙা স্বপ্ন আর নিঃশব্দ যন্ত্রণার রূপ।

গৌতম ঘোষের ‘পার’ ছিল কঠিন বাস্তবের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। গ্রামীণ দরিদ্র জীবনের সংগ্রাম, ক্ষুধা আর টিকে থাকার লড়াইয়ে শাবানা আজমির চরিত্র যেন সেই মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এ ছবির জন্যই তিনি পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অকপট ও নির্ভীক অভিনয়ে তিনি দর্শককে পরিচয় করিয়েছিলেন গ্রামীণ দারিদ্র্যের নগ্ন বাস্তবের সঙ্গে।

দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ ছিল ভারতীয় সমাজে আলোড়ন তোলা ছবি। লিঙ্গবৈষম্য, যৌনতা আর ভালোবাসার প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এটি। ‘রাধা’ চরিত্রে শাবানা আজমি দেখিয়েছিলেন এক নারীর নিজস্ব পরিচয় আর ভালোবাসার খোঁজ। তাঁর এই সাহসী অভিনয় আজও ভারতীয় সিনেমায় মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
পদাতিক নাট্য সংসদ এর নতুন নাটক আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর
পদাতিক নাট্য সংসদ এর নতুন নাটক আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর
বিস্ফোরক যে মন্তব্য করে আলোচনায় পরেশ রাওয়াল
বিস্ফোরক যে মন্তব্য করে আলোচনায় পরেশ রাওয়াল
‘বোম্বে ভেলভেট’এ রণবীর সিং এর পরিবর্তে রণবীর কাপুর
‘বোম্বে ভেলভেট’এ রণবীর সিং এর পরিবর্তে রণবীর কাপুর
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ, যে সিনেমা মুক্তি স্থগিত চেয়ে রিট
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ, যে সিনেমা মুক্তি স্থগিত চেয়ে রিট