
প্রবীর বড়ুয়া চৌধুরী: বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকার দূষণের মাত্রার কোন মাত্রা জ্ঞান নেই। প্রতিদিনের দূষণ আগের দিনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের মানসূচকে ঢাকার গড় বায়ুমান প্রায়ই ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাঝে মাঝে বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বায়ুর মানের কিছুটা উন্নতি হলেও বেশির ভাগ সময়ে ‘অস্বাস্থ্যকর’ থাকছে।
আইকিউএয়ার বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে তথ্য দেয় এবং সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়।
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান হলো বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি। গত ২০ এপিল আইকিউএয়ারের মানসূচকে ঢাকার গড় বায়ুমান ছিলো ১৭৬। এ মানকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে, এই মান দেখে বোঝার উপায় নেই পরিস্থিতি এর চাইতে খারাপ। নগরীর তিন স্থানে অবশ্য বায়ুর মান এর চেয়ে অনেক খারাপ ছিলো। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। আইকিউএয়ারের হিসেবে গড় বায়ুমান ছিলো ২৪৬। এর পর মিরপুর-৬ এর শিয়ালবাড়ি সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টার ও সাভারের নবীনগর। সেখানে বায়ুমান যথাক্রমে ২২৩ ও ২০৪।
এদিনে সতর্কবার্তায় ঢাকাবাসীকে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া খোলা স্থানে ব্যায়াম করা যাবে না। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতেও বলা হয়। বায়ুর মান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় গত বছরের ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এক দিনও নির্মল বায়ু পায়নি রাজধানীবাসী। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় প্রতিদিন ঢাকার মানুষ কতটা দূষণের শিকার হচ্ছে। দূষণ রোধে হাঁকডাক ও নানা ধরনের প্রকল্পও কম হয়নি সরকার, কিন্তু দূষণ কমছে না। দূষণসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে বায়ুদূষণ ছিল গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেও দূষণের মান ছিল ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মার্চ মাসেও দূষণ পরিস্থিতি ছিল মারাত্মক।
কেনো এই নিয়ন্ত্রণহীন দূষণ: ঢাকার এই দূষণের জন্য ৫টি কারণকে দায়ী করা হয়। কারণগুলো হলো : নির্মাণকাজের ধুলা-বালি, শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানো, ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন।
নির্মাণকাজের ফলে দূষণ: রাজধানীতে সারাবছরই ছোট-বড় অজস্র ভবন নির্মাণ এবং রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। এছাড়া গত কয়েকবছরে যোগ হয়েছে মেট্রো-রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প। এসব কাজের ফলে যে ধরণের দূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন ছিলো তা নেয়া হয়নি।
ইটভাটা ও শিল্প কারখানার ফলে দূষণ: ক্যাপস-এর ‘দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ু দূষণ সমীক্ষা ২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশেপাশের প্রায় ১২০০টি ইটভাটা, কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। এইসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। এর থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সাথে মেশে।
যানবাহন এর কালো ধোঁয়া: ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় কালো ধোঁয়ার উৎসব। চারপাশকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ছুটে চলছে বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন যানবাহন। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই মেয়াদ শেষ। এগুলো দূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মনযোগ নাই।
বর্জ্য পোড়ানো: ময়লার স্তূপে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেকসময় এই মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। আবার, অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে বাসা বাড়িতে বা মহল্লায় বর্জ্য পোড়ায়। ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেইসব এলাকাতেই বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে।
ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন : ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ট্রান্স-বাউন্ডারি ইফেক্ট’ হিসেবে বাংলাদেশে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে। এটিকে বলে ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন বা আন্তঃমহাদেশীয় বায়ুদূষণ। মূলত বর্ষাকালে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির দিকে দিল্লি, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
মন্তব্য করুন