
		বাংলাদেশের বরেণ্য গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। একাধারে তিনি গীতিকার, চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। কিংবন্তিতুল্য এই গীতিকারের বেশ কিছু গান দেশের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে । তাঁর লেখা গানের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি, পৃথিবীতে যা বিরল। মুক্তিযুদ্ধকালীণ রচিত গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এর গীতিকার তিনি। এ ছাড়া অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান লিখে অমর হয়ে আছেন তিনি। আজ ৪ সেপ্টেম্বর তার প্রয়াণ দিবস। ২০২২ সালের এই দিনে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। ৬০ বছর ধরে বেতার, টেলিভিশন, সিনেমাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গান রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ গান শোনার জন্য রেডিওর সামনে অপেক্ষা করত। তখন দেশে টেলিভিশনও ছিল মাত্র একটি। আর সেসব সময়ে, ভোর-বিকেল-রাত মিলিয়ে বারবার বাজত যেসব গান-তার অনেকগুলোর স্রষ্টা ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাংলাদেশের অসংখ্য কালজয়ী গান, বিশেষ করে দেশাত্মবোধক সংগীতের আঙিনায় যে নামটি চিরকাল দীপ্ত হয়ে থাকবে, তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছে পুরো দেশ। তার লেখা কালজয়ী গানও অসংখ্য। পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গানের রচয়িতা গুণী এই গীতিকবি।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রের জন্য। ১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১ টি।গাজী মাজহারুল আনোয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন (জাসাস) এর সাবেক সভাপতি এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন।
ষাটের দশকের শুরুর কথা। তিনি তখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার হবেন, এটাই ছিল পরিবারের স্বপ্ন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কবিতা লিখতেন নিয়মিত। কুমিল্লায় স্কুলজীবন থেকেই দেয়ালপত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতো।
একদিন কলেজ নাটকের জন্য একটি গানের দরকার হলো। প্রথমে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালকে, কিন্তু সময়াভাবে তিনি লিখতে পারলেন না। তখন সাহস করে এগিয়ে এলেন তরুণ গাজী মাজহারুল আনোয়ার। লিখলেন তাঁর জীবনের প্রথম গান। সেটিই হয়ে উঠল তাঁর গীতিকার জীবনের হাতেখড়ি।পরে একদিন ফরিদা ইয়াসমিন সেই গান রেডিওতে গাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম যায়নি, তবে মনের ভেতরে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল-‘গান আমি লিখতে পারি, আর এ পথেই হয়তো আমার ভাগ্য লুকিয়ে আছে।’ সেখান থেকেই শুরু হলো অদম্য পথচলা।
প্রথম গান লেখার পর তাঁর পথ চলা ছিল দারুণ সৃষ্টিশীল। শুরুর পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখেছেন ২০ হাজারেরও বেশি গান। দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, ভালোবাসা, মানুষের সুখ-দুঃখ-সবই উঠে এসেছে তাঁর কলমে। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ প্রভৃতি গান আজও বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন।
২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় তাঁর তিনটি গান জায়গা করে নেয়-‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’।
বাংলাদেশের শীর্ষ কণ্ঠশিল্পীদের ক্যারিয়ারও উজ্জ্বল হয়েছে তাঁর লেখা গান দিয়ে। শাহনাজ রহমতউল্লাহ, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, সাবিনা ইয়াসমিন-সবাই গেয়েছেন তাঁর সৃষ্টি। রুনা লায়লার চলচ্চিত্রে অভিষেকও হয়েছিল তাঁর লেখা গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ দিয়ে। আর সাবিনা ইয়াসমিনের কাছে তাঁর লেখা ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’ গানটি রয়ে গেছে হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের স্মৃতি হয়ে।
শুধু গীতিকার নন, তিনি ছিলেন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকও। পরিচালনা করেছেন পনেরোটির বেশি ছবি, প্রযোজনা করেছেন কুড়িটিরও বেশি। মজার বিষয়, একবার সাবিনা ইয়াসমিনকেও তিনি অভিনয় করিয়েছিলেন নিজের সিনেমায়। সাবিনা পরে বলেন, ‘আমি তো গান করি, কোনোদিন অভিনয় করিনি। কিন্তু তিনি জোর করেই আমাকে তাঁর ছবিতে অভিনয় করালেন। সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের অমূল্য স্মৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রেডিওতে প্রচারিত তাঁর অনেক গানের রেকর্ড ও খাতা হারিয়ে যায়। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেননি তিনি। বয়সের শেষ প্রান্তে এসেও লিখেছেন আধ্যাত্মিক সুরের গান-যেমন ‘সবাই বলে বয়েস বাড়ে আমি বলি কমেরে’, ‘আছেন আমার মোক্তার’। তবে একসময় গান লেখার নেশায় তিনি মেডিকেলের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলে তাঁর বাবা লিখেছিলেন-‘You are my lost game.’ কিন্তু পরবর্তীতে অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা হয়ে একুশে পদক অর্জন করার পর তাঁর বাবাই স্বীকার করেছিলেন-‘মানুষের পথ মানুষকেই বেছে নিতে হয়। তুই ঠিক পথেই আছিস।
তাঁর মৃত্যুর পর তিন বছর কেটে গেছে। কিন্তু যে গানগুলো তিনি রেখে গেছেন, সেগুলো আজও প্রতিদিন বাজে বাঙালির প্রাণে। আর তাই তিনি শুধু একজন গীতিকার নন-তিনি বাঙালির হৃদয়ের গীতিকবি।
এদিকে শারাফাত আনোয়ার উপল তার বাবাকে স্মরণ করে সামাজিক মাধ্যমে আজ লিখেছেন  `আব্বু …… আজ ৪ঠা সেপ্টেম্বর… তোমাকে হারানোর ৩ বছর…… অনেক কষ্ট আব্বু তোমাকে ছাড়া..তোমাকে ছাড়া এতদিন আমি কখনো থাকিনি.. Pls সবাই আমার আব্বুর জন্য দোয়া করবেন..।
এছাড়া গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিটিভিতে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘গান গেয়ে পরিচয়’। অনুষ্ঠানটি আজ রাত ১০-৩০ মিনিটে প্রচার হবে। অনুষ্ঠানে গীতিকবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণে অংশ নিয়েছেন গাজী মাহজারুল আনোয়ারের স্ত্রী জোহরা গাজী, তার ছেলে উপল, বরেণ্য কন্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম ও মুম্বাই ওয়াদুদ।
মন্তব্য করুন