মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের স্বনামধন্য অভিনেতা ও সংগঠক সাদেক বাচ্চু। পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে মঞ্চ, বেতার থেকে টেলিভিশন, পরবর্তী সময়ে সিনেমায় স্বীয় অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। ঢালিউড সিনেমায় তার অভিনয়ের কারিশমা দেখেছে দর্শক।
সাদেক বাচ্চুর আসল নাম মাহবুব আহমেদ। তিনি ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। ১৯৭০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে চাকরি শুরু করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ডাকঘরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর মৃত্যুর পর সাদেক বাচ্চুকে চাকরি দেয়া হয়। ২০১৩ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন।
নব্বই দশকে এহতেশামের ‘চাঁদনী’ সিনেমায় খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান সাদেক বাচ্চু। খল চরিত্রে জনপ্রিয়তার পরে পরিচালকেরা তাঁকে বেশির ভাগ খল চরিত্রে অভিনয়ের জন্যই ডাকতেন। খল অভিনেতা পরিচয়েই দেশজুড়ে সাদেক বাচ্চুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
খল অভিনেতাদের বিপত্তির শেষ নেই, পর্দার খল চরিত্রের সঙ্গে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনকে গুলিয়ে ফেলেন দর্শকেরা। সিনেমার কোনো কোনো খল চরিত্র দর্শকদের হৃদয়ে এতটাই দাগ কাটে যে সেই চরিত্র থেকে বের হতে পারেন না দর্শকেরা। সিনেমা হলে বসে দর্শকেরা খল অভিনেতাদের গালাগালি করেন, সরাসরি দেখা হলে উত্ত্যক্ত করতেও ছাড়েন না। খল অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর জীবনেও তেমন ঘটনা ঘটেছিল সত্তরের দশক ও পরবর্তী নানা সময়ে।
টেলিভিশন ধারাবাহিকে রাজাকারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সাদেক বাচ্চু। দর্শক মহলে তুমুল আলোচিত নাটকের এক দৃশ্যে একজনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন সাদেক বাচ্চু। সেই পর্ব প্রচারের পরদিন বোনকে আনতে ট্রেনে জামালপুর গিয়েছিলেন তিনি। স্টেশনে তাঁকে দেখে দর্শকেরা বাদামের খোসা ছুড়ে মারেন, কেউবা আবার পাথর ছুড়তে থাকেন। সে যাত্রায় কোনোমতে সেখান থেকে আসতে পেরেছিলেন এই অভিনেতা। তবে দর্শকদের বোঝাতে হয় এটা শুধুই অভিনয়।
পরবর্তী সময়ে ‘রামের সুমতি’ চলচ্চিত্রে পার্শ্বনায়কের চরিত্রে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সাদেক বাচ্চুর। এরপর ‘চাঁদনী’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করে আলোচিত হন সাদেক বাচ্চু। বেশ আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, দর্শক আমাকেও বেশির ভাগ সময় চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। মনে করে আমিও চরিত্রের মতোই। আবার দর্শকদের বুঝিয়ে বললে অনুধাবন করতে পারেন। এটা সব সময়ই উপভোগ করি। কারণ, দর্শক এর মধ্য দিয়ে চরিত্রকে মনে রাখে। এটাও একধরনের ভালোবাস।
অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তখন তিনি খুব বেশি কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছিলেন না। কমিয়ে দিয়েছেন অভিনয়। এক সাক্ষাৎকারে সাদেক বাচ্চু জানান, তিনি ইচ্ছা করে অভিনয় কমিয়ে দেননি। তিনি বলেন, যে চরিত্রে আমাদের মানায়, তেমন চরিত্র আমাদের কাছে আসে না। গল্পে আমাদের রাখা হয় না। পরিচালকেরা আমাদের কাছে আসেন না। গল্প আমাদের পছন্দ হয় না। ব্যাটে-বলে মেলে না।
সাদেক বাচ্চু আক্ষেপ করে আরও বলেছিলেন, এ দেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে মনে করা হয় অভিনয়শিল্পী সিনিয়র হয়েছেন মানে তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। কীভাবে তাকে বিতাড়িত করা যায়, সেটা ভাবতে সবাই উঠেপড়ে লাগেন। ও সিনিয়র হয়ে গেছে? তবে ওকে বাদ দিয়ে দাও। অথচ যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশ তাল মিলিয়ে নেয়। পুরোনো মানুষকে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা ছাড়ে না। পুরোনোরা পুরোনো অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুনদের সমৃদ্ধ করে। নতুনেরা তাদের আধুনিকতা দিয়ে পুরোনোদের বরণ করে নেয়। এই যে দেওয়া-নেওয়া, এই যে দুই দলের সংমিশ্রণ, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যেখানে এসব মানা হয় না।
সাদেক বাচ্চু অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘জীবন নদীর তীরে’, ‘জোর করে ভালোবাসা হয় না’, ‘তোমার মাঝে আমি’, ‘ঢাকা টু বোম্বে’, ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’, ‘এক জবান’, ‘আমার স্বপ্ন আমার সংসার’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’, ‘বধূবরণ’, ‘ময়দান’, ‘আমার প্রাণের স্বামী’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘প্রিয়জন’, ‘সুজন সখী’ প্রভৃতি।
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান অভিনেতা সাদেক বাচ্চু । আজ এই অভিনেতার মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের দিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
মন্তব্য করুন
