
		নতুন বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ১৫ জুলাই আজ। কোটা সংস্কারের দাবিতে লাগাতার কয়েকদিন ধরে চলা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের হামলায় সারাদেশে চার শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আহত হন ২৯৭ জন শিক্ষার্থী। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
এদিন হাসপাতালে গিয়েও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। আগের দিন ১৪ জুলাই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করেন।
এ কটূক্তির প্রতিবাদে রাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাত ১১টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হলসহ প্রায় প্রতিটি আবাসিক হল থেকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন শত শত শিক্ষার্থী। পরের দিন ১৫ জুলাই ধানম-িতে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তারা আত্মস্বীকৃত রাজাকার, গত রাতে নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এর জবাব ছাত্রলীগই দেবে।
সেদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়েছে, তাদের শেষ দেখে ছাড়বেন বলে হুমকি দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। এই দুইজনের এমন বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর স্বশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশের প্রত্যেক ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেয়া হয়। এই আন্দোলনে দেশের সবাইকে গণজমায়েতের আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে ২৪’র ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা সমাবেশও শুরু করেন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই মারধরের শিকার হন। এক পর্যায়ে টিএসসি থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ তাদের সাথে যুক্ত হলে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনের জায়গা থেকে পিছু হটেন।
তাঁদের একটি দল ফুলার রোড হয়ে এবং আরেকটি দল স্যার এ এফ রহমান হলের সামনের রাস্তা দিয়ে নীলক্ষেতের দিকে সরে যায়। অপর দিকে বিজয় একাত্তর হলের সামনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীরাও বিকেল চারটার দিকে পিছু হটেন। এসময় ছাত্রলীগ লাঠিসোটা, রড, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, জিআই পাইপসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয় এবং বিচ্ছিন্নভাবে যাদের যেখানে পেয়েছে সেখানে বেধড়ক পেটায়। এতে বাদ যায়নি নারী শিক্ষার্থীরাও। তাদের হামলা ও মারধরে অনেক শিক্ষার্থী ভয়াবহ জখম ও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও তাদের ওপর চলে হামলা ও লাঠিপেটা।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে ঢাবি ছাত্রলীগের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক বহিরাগত ক্যাম্পাসে আনে ছাত্রলীগ। বহিরাগত এসব যুবক খুঁজে খুঁজে নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। হামলায় আহত এক নারী শিক্ষার্থী নিজের ফেসবুকে লাইভে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে শোনা যায়, ‘আজ নিজ ক্যাম্পাসেই নিজে বহিরাগত হলাম!’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগ আমাদের ক্যাম্পাসেই বহিরাগত এনে আমাদের আঘাত করেছে।
বেলা গড়াতেই ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। রড, জিআই পাইপ ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাস জুড়ে মিছিল দিতে দেখা যায় তাদের। দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেন তারা। হামলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্তত আড়াই শতাধিক আহত হয়। তাদের হামলায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ মহড়া দিতে থাকে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে শিক্ষার্থীদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
বিকাল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক অতিক্রম করে মিছিল নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মী ঢাকা মেডিক্যালের সামনে জড়ো হয়। আরেকটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন দোয়েল চত্বর এলাকায় অবস্থান নেয়। এসময় মাঝখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুহুর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো চাঁনখারপুল,ঢাকা মেডিক্যাল ও দোয়েল চত্বর এলাকা।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সি বিভাগের ভেতর দফায় দফায় হামলা করে ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রড, চাইনিজ কুড়াল নিয়ে হেলমেট পরে, লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢামেকে প্রবেশ করে। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর আবারও হামলা চালায়। এছাড়াও ঢামেকে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে তারা।
এসময় পুরো মেডিক্যালের রোগিদের মাঝেও ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় শহীদুল্লাহ হলের সামনে অবস্থান নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে কার্জন হলের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগের সহস্রাধিক নেতাকর্মীর সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটে। ইট পাটকেলের পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শটগানের শব্দ কিংবা ককটেলের বিস্ফোরণ করা হয় ৮বার। এসময় দফায় দফায় এই সংঘর্ষ আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, রামপুরা, নতুন বাজার, স্যায়েন্স ল্যাব, শেরেবাংলা নগর, মহাখালিসহ বিভিন্ন স্পটে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান।
নতুন বাজার, আফতাবনগর ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে পৃথকভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে ব্র্যাক, নর্থসাউথ, ইস্টওয়েস্ট ও ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীর দুপুরে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন। সমাবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কে রাজাকার কে রাজাকার, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন সেøাগান দিতে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এর আগে থেকে থেকে শাটল ট্রেনের বগিতে বগিতে তদারকি করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় চবি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহ সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে দেখে ঘিরে ধরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপগ্রুপের নেতারা। ধস্তাধস্তি করে তাকে তুলে নিয়ে যায় যাওয়া হয়। পরে রাফিকে নিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল প্রক্টর অফিসে গিয়ে প্রক্টরের কাছে তাকে তুলে দেয়।
এ সময় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা বলেন, যারা রাজাকার পরিচয় দিয়েছে তাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে ঠাঁই নাই। যে ছেলে কোটা সুবিধা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এদের পেছনে কোন অপশক্তির ইন্ধন আছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। এদের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। এদিকে আন্দোলনের সমন্বয়ক রাফিকে তুলে নেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মেয়েদের হল থেকে অনেক মেয়ে প্রক্টর অফিসের সামনে চলে আসেন। পূর্ব থেকেই ছাত্রলীগের অবস্থান থাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
হাসিনার মন্তব্যের প্রতিবাদে রাবি-রুয়েট শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে এসে শেষ হয়। এ সময় তারা ‘লাখো শহিদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাবার না, চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার আমি নই তুমি নই রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার সরকার? এসব সেøাগান দিতে থাকেন। পরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও অংশ নেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে হলের প্রভোস্ট পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন প্রফেসর নাজমুল হাসান তালুকদার। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগ।
কোটা আন্দোলনকারীদের নিয়ে শেখ হাসিনার কটুক্তির প্রতিবাদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধা অতিক্রম করে পুরান ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে এসে বিক্ষোভে যোগ দেন। এর আগে জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও কোটা আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
এদিকে কোটা আন্দোলনে যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে, তাদেরকে ‘এ যুগের রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, ‘এ যুগের রাজাকারদের পরিণতি, ওই যুগের রাজাকারদের মতোই হবে।’
মন্তব্য করুন