বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

ঘুমহীন যে গ্রাম অভিশাপের সূচনা

বৈশাখী ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:২০ পিএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৪ পিএম

পাঠক এমন ভাবনা কি আপনার মনে এসেছে যে, প্রতিদিন রাতে যখন আমরা ক্লান্ত দেহটা শুইয়ে স্বপ্নের জগতে পাড়ি দিই, তখন কি কখনো ভেবেছি ঘুম যদি চিরতরে হারিয়ে যায়,তাহলে কী হবে? ইতালির এক নির্জন পাহাড়ি গ্রামে, কিছু পরিবার প্রতিনিয়ত লড়ছে এমন এক দুঃস্বপ্নের সাথে-যা আসলে একটি ভয়ংকর বাস্তবতা। রোগটির নাম-Fatal Familial Insomnia, সংক্ষেপে FFI। এটি কোনো কল্পকাহিনি নয়, বরং এক জেনেটিক অভিশাপ, যা ধীরে ধীরে কেড়ে নেয় ঘুম, ছিনিয়ে নেয় জীবন।

মনে করুন-আপনি ঘুমাতে পারছেন না। এক দিন, দুই দিন নয়-সপ্তাহ, মাস, এমনকি বছর। আপনার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে ঘুমের ক্ষমতা। আপনি জেগে জেগেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছেন।

১৯৮৬ সালে এলিও লুগারেসি ও তার সহকর্মীরা প্রথম এই রোগের নামকরণ করেন। তাদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একজন ইতালীয়-সিলভানো।এই ব্যক্তির গল্প দিয়েই শুরু হয়েছিল এক ভয়ানক সত্যের উন্মোচন। ঘুম না থাকলে শুধু ক্লান্তি নয়, হারিয়ে যায় চেতনাও। আর যখন ঘুমের দরজা বন্ধ হয় চিরতরে, তখন মৃত্যুও হয় অপেক্ষমাণ এক বাস্তবতা।

১৯৮৩ সালের এক রাতে, বোলোনিয়ার ঘুম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন একজন অদ্ভুত রোগী যিনি ঘুমে অক্ষম, উদ্বিগ্ন, বিভ্রান্ত। তাঁর নাম ছিল সিলভানো।স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইগনাজিও রইটার এই মামলাটি পাঠালেন ঘুম বিশেষজ্ঞ প্রফেসর লুগারেসির কাছে। শুরু হয় পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা নিরীক্ষা।একের পর এক রাত কেটে গেল, কিন্তু ঘুম আসলো না। আসলো স্মৃতিভ্রংশ, এলোমেলো কথা, অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া।

সিলভানোর নিজের ইচ্ছাতেই তার মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করা হয় গবেষণার জন্য।এই আত্মত্যাগই খুলে দেয় এক ভয়ানক রোগের রহস্য-FFI, যেটি এক জেনেটিক মিউটেশন থেকে জন্ম নেয়।

১৯৯৮ সালের মধ্যে ৪০টি পরিবারের মাঝে এই রোগের জিন পাওয়া যায়।ইতালি, জার্মানি, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া- FFIs গ্লোবাল রূপরেখা তৈরি করতে থাকে। সিলভানোর মৃত্যু এক ট্র্যাজেডি ছিল, কিন্তু তার দান ছিল ভবিষ্যতের জন্য এক আলোকবর্তিকা-FFI কে চিনতে, বুঝতে এবং একদিন হয়তো প্রতিকার খুঁজে পেতে।

প্রিয়ন প্রোটিনের রহস্য : ঘুমের চাবিকাঠি কোথায়? উত্তরটি মস্তিষ্কের মাঝখানে যার নাম থ্যালামাস।এবং এই থ্যালামাসকেই আক্রমণ করে এক বিষাক্ত প্রোটিন, যার নাম-প্রিয়ন।FFI-এর মূল কারণ হলো PRNP জিনে থাকা D178N নামক এক মিউটেশন।এর ফলে শরীরে তৈরি হয় অস্বাভাবিক প্রিয়ন প্রোটিন, যা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের টিস্যু ধ্বংস করে।

লক্ষণগুলো শুরু হয় সাধারণ অনিদ্রা দিয়ে। তারপর আসে স্মৃতিভ্রংশ, এলোমেলো কথা, হ্যালুসিনেশন।একজন ব্যক্তি জেগে থাকেন, কিন্তু বিভ্রান্ত। মন জেগে থাকে, শরীর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়।সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়-এই রোগের কোনো নিরাময় নেই।ঘুমানোর ওষুধ, ধ্যান, হিপনোসিস—কোনো কিছুই কাজ করে না।অবশেষে, রোগী জেগে জেগেই মৃত্যু বরণ করেন।একটি ছোট্ট প্রোটিন, একটিমাত্র জিনের ত্রুটি-আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যায় চেতনা, ব্যক্তিত্ব, মানবিকতা। FFI এর নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে তার নির্মম ভবিষ্যৎ-Fatal।

বিশ্বজুড়ে জেনেটিক অভিশাপ : ছোট্ট একটি গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে এক ভয়ংকর অভিশাপ—বিশ্বজুড়ে মাত্র ২০০-র কম পরিবার জানে, একদিন তাদের ঘুম চিরতরে হারিয়ে যাবে।FFI কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়, এটি বংশগত।অস্ট্রিয়া, আমেরিকা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস—প্রতিটি কেস যেন এক একটি ভিন্ন ট্র্যাজেডি।মিশরের বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি ১৯ বছর নেদারল্যান্ডসে কাটানোর পর হঠাৎ করে আক্রান্ত হন।

দিনের পর দিন বিভ্রান্তি, স্মৃতি হারানো, এলোমেলো চলাফেরা-সবশেষে মৃত্যু।এটি এমন এক রোগ, যেখানে জানার চেয়ে না জানাই ভালো” বলে মনে হতে পারে।কারণ আপনি হয়তো জানেন, আপনার জিনে আছে সেই ত্রুটি, কিন্তু কখন তা সক্রিয় হবে, কেউ জানে না। FFI শুধু একটি রোগ নয়, এটি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, যেখানে সময়ই শত্রু।ঘুম যেখানে স্বস্তির আশ্রয়, সেখানে তা হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুর চিহ্ন।

ঘুম-জীবনের অপরিহার্য গল্পঘুম-এটি শুধু বিশ্রাম নয়। এটি আমাদের স্মৃতি, আবেগ, সিদ্ধান্ত, এমনকি অস্তিত্বের মূল।”FFI আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়-ঘুম না থাকলে আমরা মানুষ থাকি না।আমাদের ভেতরের ‘মানবতা’ জেগে থাকলেও শরীর তা বহন করতে পারে না। এই রোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিজ্ঞান গবেষণার কতটা প্রয়োজন, এবং বিরল রোগগুলো নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা কতটা জরুরি।হয়তো একদিন, জেনেটিক থেরাপি, স্টেম সেল বা প্রিয়ন নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির মাধ্যমেএই অভিশাপ থেমে যাবে। ততদিন পর্যন্ত, FFI যেন এক সতর্ক সংকেত-জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি ঘুম,একটি অমূল্য উপহার। তাই প্রতিদিন ঘুমানোর আগে, একবার ভাবুন-আপনি কত ভাগ্যবান।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বৃষ্টি জলপ্রপাতের মতো না পরে ফোঁটায় ফোঁটায় পরে কেন ?
বৃষ্টি জলপ্রপাতের মতো না পরে ফোঁটায় ফোঁটায় পরে কেন ?
ফেনীর ছিন্নমূল মানুষের ভরসা ‘ইচ্ছেমতো দামের হোটেল’ 
ফেনীর ছিন্নমূল মানুষের ভরসা ‘ইচ্ছেমতো দামের হোটেল’ 
নেদারল্যান্ডসকে কেন সাইকেলের দেশ বলা হয় ?
নেদারল্যান্ডসকে কেন সাইকেলের দেশ বলা হয় ?
মুভি দেখার সময় সবাই পপকর্ন কেন খায় ?
মুভি দেখার সময় সবাই পপকর্ন কেন খায় ?