
		আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধ। অথচ প্রতিবারই এই নারকীয় অত্যাচারের শিকার মেয়েদের ‘নির্ভয়া’, ‘অভয়া’, ‘বীরাঙ্গনা’— এমন নানান উপাধিতে অভিহিত করা হয়। প্রশ্ন জাগে, কেন? কেন ধর্ষণের পরও সমাজ চায়, মেয়েটিই হোক নির্ভীক, বীর? কেন রাষ্ট্র, আইন, সমাজ তাকে সেই নিরাপত্তা দিতে পারে না, যেখানে তাকে আর বীর হতে না হয়? সমাজ কি এতোটাই অন্ধ?
ধর্ষণ কোনো যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ নয়, বরং এটি মূলত ক্ষমতার প্রদর্শন। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ধর্ষণের সংজ্ঞা সময়ে সময়ে বদলেছে। এক সময় মেয়েদের শরীর তাদের পিতা বা স্বামীর সম্পত্তি বলে গণ্য করা হতো। সেই যুগে ধর্ষণকে মেয়ের ওপর নয়, বরং তার পরিবারের মান-ইজ্জতের ওপর আক্রমণ বলে দেখা হত। এমনকি, অনেক সভ্যতায় ধর্ষণকে ‘চুরি’ হিসেবে গণ্য করা হতো— যেন মেয়ের কৌমার্য কোনো লুকোনো রত্ন, যা হারালে পরিবারের ‘মর্যাদা’ নষ্ট হয়।
আজকের সমাজ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে, আইনও অনেক বদলেছে। কিন্তু সমাজের মন বদলেছে কতোটা? ধর্ষণ এখনও ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন শত্রুর জমি দখল করা হয়, তেমনই নারীদেহ লুণ্ঠন হয় বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। ধর্ষণ শুধু শারীরিক আঘাত নয়, বরং নারীর চেয়ে বেশি আঘাত দেয়া হয় সমাজের বুকে, যার গভীরে লুকিয়ে থাকে লিঙ্গ, শ্রেণি, বর্ণ, ধর্ম— সব কিছুর রাজনীতি।
এখনও সমাজে বহু ধর্ষক বুক ফুলিয়ে বলে, “আমার কিছু হবে না।” কারণ তার পাশে থাকে ক্ষমতা, প্রভাব, বা কোনো না কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়া। ক্ষমতার রাজনীতি আর ধর্ষণের রাজনীতি তাই বারবার মিলে যায়। ধর্ষণ এক ধরনের ‘ভয়ের রাজনীতি’, যেখানে মেয়েদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, যে তারা নিরাপদ নয়, এবং ক্ষমতাশালীরা চাইলেই তাদের দখল করতে পারে।
একই সঙ্গে ধর্ষণ হলো লিঙ্গ রাজনীতিরও অংশ। সমাজ এখনো নারীর শরীরকে ‘নিজস্ব’ বলে মানতে শেখেনি। কনসেন্টের কথা বলা হয়, কিন্তু ধর্ষক জানে, তার কাজই হচ্ছে সেই অনুমতি উপেক্ষা করা। বলপ্রয়োগ, জবরদস্তি, এই ক্ষমতার নেশাই তাকে চালিত করে। তাই ধর্ষণের লড়াই কেবল আইনের লড়াই নয়, বরং মানসিকতার লড়াই। যত দিন না আমরা নারী, পুরুষ, বা যে কোনো মানুষের শরীরকে তার নিজের বলে মানতে শিখছি, তত দিন ধর্ষণকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।
ধর্ষণকে বোঝার জন্য ক্ষমতার রাজনীতি বোঝা জরুরি। কারণ ধর্ষণ মানেই ক্ষমতার লোভ, দখলের নেশা। আর সেই লোভ থেকে জন্ম নেয় প্রলয়, যা কোনোভাবেই থামে না, যত দিন না বদলায় মানুষের মন।
মন্তব্য করুন