বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫

ময়মনসিংহে ‘আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা: অংশীজনের প্রত্যাশা’বিষয়ক মতবিনিময় সভা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম

ময়মনসিংহে আজ বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) `আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা: অংশীজনের প্রত্যাশা' বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় গ্রীণ সিটি ট্রেনিং সেন্টারে অনুষ্ঠিত ওই সভার আয়োজন করে স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি এবং গণসাক্ষরতা অভিযান। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার পাল। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোখতার আহমেদ।

এ সময় তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কুল মিলের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের দেশেও স্কুল মিল কার্যক্রমকে বেগবান করতে হবে। আদিবাসীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনে যাঁরা আছেন তাঁরা অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষক নিয়োগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করাও একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব সেক্ষেত্রে তাঁদের প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধির জন্য কিছু বিশেষ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সভায় ‘আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা: অংশীজনের প্রত্যাশা’ বিষয়ক মুল আলোচনা পত্র উপস্থাপন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক একেএম মাজহারুল ইসলাম। এ সময় তিনি আলোচনায় দারিদ্রতা আদিবাসীদের জীবন জীবিকা ও শিক্ষায় অভিগম্যতাকে বাঁধাগ্রস্থ করে। আদিবাসী শিশুদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি ও ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে শিশুশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার, মাদকাসক্তি ও বাল্যবিবাহকে প্রধানত দায়ী করেন তিনি। এর পাশাপাশি জীবিকার সন্ধানে অভিভাবকদের সাময়িক অনুপস্থিতি এবং শিশুদের শিক্ষার প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের অমনোযোগিতা ও অংশগ্রহণের ঘাটতি এই ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। আদিবাসী ভাষার শিক্ষকের অপ্রতুলতা, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসমতা, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে প্রস্তুতির ঘাটতি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জীবনকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। শিখনফল ঘাটতি নিরসনে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।

নির্ধারিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক এন্ড অ্যাডাল্ট এডুকেশনের ক্যাপাসিটি সাপোর্ট অ্যাডভাইজার কেএম এনামুল হক। তিনি বলেন, শিক্ষার সংস্থান, প্রবেশগম্যতা, মান ও অভিযোজন শিক্ষা অধিকার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয়ের অপর্যাপ্ততা, প্রয়োজনীয় শিক্ষক না থাকা এবং পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি না থাকায় আদিবাসী শিশুরা নানাবিধ ঝুঁকির মুখোমুখি হয়। যা তাঁদের শিক্ষা জীবন ব্যহত করে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, মাতৃভাষায় শিক্ষা, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নসহ সামাজিক সুরক্ষা বলয় বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের দাবিও জানান তিনি।

সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, গণসাক্ষরতা অভিযান ঢাকার প্রোগ্রাম অফিসার সিজুল ইসলাম। এছাড়াও উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক স্বপ্না পাপুল, আনন্দ মোহন কলেজের দর্শন বিভাগের আশরাফ-উজ জামান, সহকারী অধ্যাপক নওরীন সামান্তা সৌমি, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (ন্যাপ) এর প্রোগ্রামার মোস্তাফিজুর রহমান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হারুন-অর রশীদ, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাজনীন সুলতানা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু ইউসূফ খান, সেবা’র নির্বাহী পরিচালক ইউসূফ আকন্দ মজিবুর, ময়মনসিংহ সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মনিকা পারভীন, হালুয়াঘাট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান, হালুয়াঘাট সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মাহমুদুল হাসান, মুক্তাগাছার সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাহিদা সুলতানা, হালুয়াঘাট কমিউনিটি এডুকেশন ওয়াচ গ্রুপের সংগঠক বুলবুল রিচিল, গার্লস ফোরামের অপ্সরা দালবৎ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির প্রজেক্ট ম্যানেজার ইমন সরকার।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ সদর ও হালুয়াঘাট উপজেলার গারো, হাজং সম্প্রদায়সহ আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উন্নয়নকর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার অর্ধশতাধিক প্রতিনিধি।

সভায় উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা অর্জনে চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা এবং করণীয় নিয়ে তাঁদের মতামত এবং সুপারিশ তুলে ধরেন। আলোচকরা বলেন, কমিউনিটি ভিত্তিক স্কুলের ব্যবস্থা করা সেইসাথে প্যারা শিক্ষক নিয়োগ করা, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে মিড-ডে মিল কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা, যাতায়াত বা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মেয়েদের জন্য প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের ব্যবস্থা করা, আদিবাসীরা দূর্গম এলাকাগুলোতে বসবাস করেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, দারিদ্রতা ও কর্মের জন্য রাজধানী বা অন্যত্র যেসব অভিভাবকরা চলে যান তাঁদের শিশু সন্তানরা অবহেলিত হচ্ছে। রাস্তাঘাটে আদিবাসী মেয়ে শিক্ষার্থীরা চলাচলের সময় সংখ্যাগুরুদের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে।

সীমান্তঘেঁষা এই জেলায় বালু ও পাথর উত্তোলনের সাথেও শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছেন আদিবাসী শিশুরা। মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে শিক্ষা প্রদানে স্কুল, কমিউনিটি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ জিও-এনজিওর সমন্বয় বৃদ্ধি করে কাজ করার সুপারিশ জানানো হয়। আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকাগুলোতে স্কুলে আবাসন সুবিধা যুক্ত করা, নিজ ইউনিয়নে শিক্ষকদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া যাতে সাংস্কৃতিক সংযোগ বজায় থাকে, দোভাষী শিক্ষকদের আলাদা প্রণোদনা দেওয়া, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, মেয়ে শিশুদের শিক্ষায় বিশেষ সুরক্ষা ও প্রণোদনা প্রদান করা, স্কুলে জাতিগত বৈষম্য, বুলিং ও অপমানের ঘটনা প্রতিরোধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া, প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়ানো, আদিবাসী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। সবশেষে, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করেন অংশগ্রহণকারীরা।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
গুইমারার রামসুবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ৯৭ পরিবারকে অর্থ সহায়তা প্রদান
গুইমারার রামসুবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ৯৭ পরিবারকে অর্থ সহায়তা প্রদান
প্রযুক্তি সহিংসতা রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা জরুরি
প্রযুক্তি সহিংসতা রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা জরুরি
চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচনে মনোনয়ন বোর্ড যথাযথ বিবেচনা করবে: মীর সরফত আলী সপু
চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচনে মনোনয়ন বোর্ড যথাযথ বিবেচনা করবে: মীর সরফত আলী সপু
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযানে দুদক
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অভিযানে দুদক